বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে সড়ক ও রেল অবকাঠামোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। অথচ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মহাসড়কের গুণগত মান খারাপ। এগুলো আধুনিক ও ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়। আর রেলপথে পণ্য পরিবহন ক্রমেই কমছে।
Published in Bonik Barta on Saturday, 3 October 2015.
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের পর্যবেক্ষণ
উন্নয়ন হয়নি সড়ক ও রেল অবকাঠামোয়
ইসমাইল আলী
দেশে সড়ক ও রেলের উন্নয়নে গত পাঁচ বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। নেয়া হয়েছে তিনশর বেশি প্রকল্প। তবে সুফল মেলেনি বিশাল এ বিনিয়োগের। উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়নই হয়নি সড়ক বা রেল অবকাঠামোর। বরং দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত দুই সূচকেই সবচেয়ে নিচে রয়েছে বাংলাদেশ। গত বুধবার বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১৫-২০১৬’তে এ চিত্র উঠে আসে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল অবকাঠামো সংস্কার সূচকে স্কোর বাড়েনি। বরং অবস্থানের দিক থেকে দুই ধাপ করে পিছিয়ে খাত দুটি। এটি মূলত অবকাঠামো দুর্বলতারই চিত্র তুলে ধরে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সড়ক বা রেল খাতের উন্নয়নে সরকার নিয়মিত ব্যয় করছে। তবে এর গুণগত ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় সূচক দুটিতে বাংলাদেশ এগোয়নি।
প্রতিবেদনটিতে দেয়া গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে গুণগত মানের দিক থেকে বাংলাদেশের সড়কের অবস্থান ১৪০টি দেশের মধ্যে ১১৩। স্কোর ৭-এর মধ্যে ২ দশমিক ৯। আর ২০১০ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সড়কের অবস্থান ছিল ১১১। সে সময় স্কোর ছিল ৭-এর মধ্যে ২ দশমিক ৯। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সড়কের গুণগত মানের কোনো উন্নয়ন হয়নি। ফলে স্কোরও বাড়েনি। উল্টো অন্যরা কিছুটা এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান নেমে গেছে।
একই ধরনের চিত্র রেলের ক্ষেত্রেও। রেল অবকাঠামোর দিক দিয়ে বর্তমানে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫। এক্ষেত্রে স্কোর ৭-এর মধ্যে ২ দশমিক ৫। ২০১০ সালে রেল অবকাঠামোয় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৩। সে সময় স্কোর ছিল ৭-এর মধ্যে ২ দশমিক ৫।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক বা রেলের উন্নয়নে পাঁচ বছরে বিনিয়োগ হলেও তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সড়ক শুধু প্রশস্ত করলেই চলবে না, তার ব্যবহার সময় কমছে কিনা, সেটা দেখা জরুরি। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা লাগত। অথচ এখন স্বাভাবিকভাবেই ৮-৯ ঘণ্টা লাগছে। অর্থাৎ চার লেন হলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সড়কের পাশে বাজার, দোকান, স্থাপনা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিনিয়োগের পরিকল্পিত ব্যবহার নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। কারণ অনেকটা অ্যাডহক ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কী ধরনের প্রকল্প নেয়া দরকার, তা অনেক ক্ষেত্রেই যাচাই করা হয়নি। ফলে বিনিয়োগের কোনো সুফল আসলে মেলেনি।
তিনি আরো বলেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক মূলত করা হয় বিনিয়োগকারীদের কথা মাথায় রেখে। এর মাধ্যমে তাদের সামনে একটি দেশের অবস্থা তুলে ধরা হয়। আর সড়ক বা রেলের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা চান গতিশীলতা (মোবিলিটি)। অর্থাৎ কত দ্রুত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া যায়। তবে গত পাঁচ বছরে দেশের রেল বা সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে গতিশীলতা বাড়েনি।
যদিও এ সময়ে সড়ক ও রেল খাতে বিনিয়োগে গতিশীলতা বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে সড়ক উন্নয়নে ১৭ হাজার ১৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে এ খাতে বিনিয়োগ করা হয় ২ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ হাজার ৮৪৭ কোটি, ২০১২-১৩তে ৩ হাজার ৬০৫ কোটি, ২০১৩-১৪তে ৩ হাজার ৬২৫ কোটি ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
পাঁচ বছরে রেল উন্নয়নে ব্যয় করা হয় ১৩ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে বিনিয়োগ করা হয় ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ হাজার ২৬৬ কোটি, ২০১২-১৩তে ৩ হাজার ২২ কোটি, ২০১৩-১৪তে ৩ হাজার ৬৬৯ কোটি ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
কিন্তু এসব বিনিয়োগের সুফল যে মেলেনি, তার প্রমাণ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১৫-২০১৬। এতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সড়ক অবকাঠামোয় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। আর ভালো অবস্থানে শ্রীলংকা। ১৪০টি দেশের মধ্যে শ্রীলংকার অবস্থান ২৭, স্কোর ৭-এর মধ্যে ৫ দশমিক ২। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থান ৬১, স্কোর ৪ দশমিক ১। ভুটানের অবস্থান ৬৭, স্কোর ৪। পাকিস্তানের অবস্থান ৭৭, স্কোর ৩ দশমিক ৮। আর নেপালের স্কোর বাংলাদেশের সমান ২ দশমিক ৯।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ও ভুটানে রেলপথ নেই। বাকি চারটি দেশের মধ্যে রেল অবকাঠামোয়ও বাংলাদেশ সবার পেছনে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভারত। দেশটির অবস্থান ১৪০-এর মধ্যে ২৯। আর স্কোর ৭-এর মধ্যে ৪ দশমিক ১। শ্রীলংকার অবস্থান ৩৭, স্কোর ৩ দশমিক ৯। পাকিস্তানের অবস্থান ৬০, স্কোর ২ দশমিক ৮।
জানতে চাইলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বাংলাদেশী সহযোগী সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে সড়ক ও রেল অবকাঠামোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। অথচ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মহাসড়কের গুণগত মান খারাপ। এগুলো আধুনিক ও ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়। আর রেলপথে পণ্য পরিবহন ক্রমেই কমছে।
গত কয়েক বছরে সড়ক খাতের কোনো উন্নয়ন যে হয়নি, বিভিন্ন গবেষণায়ও এ তথ্য উঠে আসছে। চলতি বছর ইউএন-এসক্যাপ প্রকাশিত এশিয়ান হাইওয়ে ডাটাবেজে বলা হয়েছে, দেশে এশিয়ান হাইওয়ে মানের কোনো সড়ক নেই। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৫তে বলা হয়েছে, সড়ক অবকাঠামোর গুণগত মান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। এমনকি মাথাপিছু সড়ক ও রেলপথেও দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন অবস্থানে বাংলাদেশ।