Published in Alokito Bangladesh on Monday, 24 August 2015.
রফতানি আয় বাড়ছে অপ্রচলিত পণ্যে
সহায়তায় হতে পারে বড় আয়ের উৎস
জাহিদুল ইসলাম
জীবন্ত প্রাণী, মাংস, মধু, মাথার চুল, শাকসবজি রফতানিতে প্রবৃদ্ধি শতভাগের বেশি
বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে পোশাক শিল্পের হাত ধরে। হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা এবং প্রকৌশল শিল্প মিলে রফতানি আয় আসে প্রায় ৯৫ শতাংশ। এর বাইরে ৫ শতাংশ রফতানি আয় আসে অপ্রচলিত পণ্য থেকে। তবে আশার কথা হলো পোশাকের বাইরে অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। জীবন্ত প্রাণী, মাংস, মধু, প্রাণিজ পণ্য, মাথার চুল, জবাই করা প্রাণীর ফেলনা অংশ, শাকসবজিসহ বেশকিছু পণ্য রফতানিতে বছরে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে শতভাগের বেশি।
উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদদের মতে, রফতানি আয়ে একক পণ্য পোশাকে নির্ভরতা অর্থনীতির জন্য কখনোই সুখকর নয়। কোনো কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশী পোশাকের বাজারে ধস নামলে বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে রফতানি বাজার। এ অবস্থায় পোশাকের বাইরেও রফতানি আয় বাড়াতে তৎপর হতে হবে। আর সে খাতটি হতে পারে অপ্রচলিত পণ্য। সরকারের সহায়তা পেলে এ খাতে বড় অঙ্কের রফতানি আয় আসতে পারে।
রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এসব বিষয়ে ইপিবির চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু বলেন, রফতানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে বিশদ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পাঁপড় উৎপাদনে উৎপাদকদের প্রশিক্ষণ দেয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একইভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে রাবার উৎপাদনেও। ইপিবির উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কারণে এখন উল্লেখযোগ্য হারে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাক রফতানিতেই বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কটনভিত্তিক পোশাক বেশি রফতানি হয়। সিনথেটিক পোশাকে গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। শিশুদের পোশাক, মহিলাদের আন্ডারগার্মেন্টসহ দামি পোশাক রফতানিতে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে ছোট ছোট খাতে ক্রেতাদের বেঁধে দেয়া মান ও কর্মপরিবেশ অনেক সময় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বাড়াতে বাজারের প্রসারও বাড়াতে হবে। অনেক দেশেই বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা থাকলেও উচ্চ শুল্ক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকা ও রাশিয়ায় আমাদের পণ্যের শুল্ক অনেক বেশি। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও রুলস অব অরিজিনের আওতায় দেশীয় মূল্য সংযোজনে উচ্চ হার বেঁধে দেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এসব সমস্যার সমাধান হলে নতুন পণ্যে রফতানি বাড়বে।
ইপিবি জানায়, গেল অর্থবছরের ১১ মাসে চকোলেট জাতীয় পণ্যে রফতানি আয় হয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময় এ খাতে আয় হয়েছিল ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এ হিসেবে পণ্যটিতে ১১ মাসে রফতানি আয় বেড়েছে ১৫০ গুণের বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ১১ মাসে রুটি, বিস্কুট ও কেক রফতানি করে আয় হয়েছিল ১৮৮ কোটি ৫৮ লাখ ৩ হাজার টাকা। গেল অর্থবছরের ১১ মাসে তা ২৬৬ কোটি ৪৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকায় উঠে আসে। ১১ মাসে এ খাতে রফতানি বাড়ে ৭৭ কোটি ৯০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। বছরে প্রবৃদ্ধি হয় ৪১ শতাংশের বেশি।
ইপিবি সূত্রে জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে মশলা জাতীয় পণ্যে রফতানি আয় হয়েছে ১০৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ১৬৯ কোটি ৪ লাখ টাকায় উঠে এসেছে। গেল অর্থবছরের ১১ মাসেই এ খাতে আয় হয়েছে ১৬১ কোটি ৭৯ লাখ ৮ হাজার টাকা। মশলা রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৫৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বছর শেষে এ খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত টেবিলওয়্যার ও অন্যান্য কিচেন সামগ্রী রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ১৯১ লাখ ৭৮ হাজার টাকার। গেল অর্থবছরের ১১ মাসে তা ৭ হাজার ৫৪০ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় উঠে আসে। বছরের ব্যবধানে আয় বাড়ে ৩ হাজার ৩৪৯ লাখ ৮ হাজার টাকা এবং প্রবৃদ্ধি হয় ৮০ শতাংশ।
রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছে সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। প্রতিষ্ঠানের আওতায় নেয়া ইপিজেডগুলোয় বেশ কয়েকটি অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদনের কাজ চলছে। গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ, তাঁবু, এলইডি বাতি, বাইসাইকেল, ব্যাটারি, ক্যামেরা, লেন্স, মোবাইলের যন্ত্রাংশ, জুয়েলারি, পরচুলা, চপস্টিকসহ বিভিন্ন অপ্রচলিত পণ্যের উৎপাদকদের বিশেষ ছাড় দিচ্ছে ইপিজেডগুলো।
বেপজার মহাপরিচালক নাজমা বিনতে আলমগীর আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ঈশ্বরদী, মংলা ও উত্তরা ইপিজেড অপ্রচলিত পণ্যের উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে। এ তিন ইপিজেডে নতুন পণ্যের উদ্যোক্তারা অর্ধেক ভাড়ায় মিল স্থাপন করতে পারেন। তাছাড়া এসব খাতে কর রেয়াত দেয়া হয় ৭ বছর- যদিও প্রচলিত পণ্যের উদ্যোক্তারা ইপিজেডে ৫ বছর কর রেয়াত পেয়ে থাকেন। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পোশাক রফতানির দেশ হিসেবে পরিচিত। আমাদের এ পরিচিতি ঘোচানোর লক্ষ্যে কাজ করছে বেপজা। যে শ্রমিক যে শিল্পের জন্য দক্ষ, তাকে সে শিল্পেই কাজে লাগানো উচিত। রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য এলে বিষয়টি অনেকটাই সহজ হবে।
এদিকে ইপিবির পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে বেশি উৎপাদন ব্যয়ের দেশ থেকে পণ্য প্রতিনিয়ত নিম্ন উৎপাদন ব্যয়ের দেশে ধাবিত হচ্ছে। শ্রমনির্ভর পণ্যগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থা এখন উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এরই মধ্যে চীনসহ বিভিন্ন দেশে এমন ঘটনা ঘটছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে এখন রফতানি আয়ের দুর্বল অবস্থানে থাকা ১২টি পণ্যের উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে খাতগুলোর সমস্যা চিহ্নিত এবং তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ১২টি খাতের মধ্যে রয়েছে জাহাজ, ওষুধ, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স, কাগজ, রাবার, আইসিটি, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাদুকা, লাগেজ, প্রিন্টেড ম্যাটেরিয়ালস ও খেলনা। দেশজ কাঁচামালনির্ভর পণ্যের রফতানি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে ইপিবি। এজন্য ‘এক জেলা এক পণ্য’ কর্মসূচির বাস্তবায়ন চলছে। এর অংশ হিসেবে বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলায় আগরউড ও আগর আতর, দিনাজপুরে পাঁপড় ও বান্দরবানে রাবারের উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ইপিবি। বাকি ১১ পণ্যের ক্ষেত্রে সংস্থাটি পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ নেবে।