Published in Samakal on Wednesday, 21 May 2014.
পাট রফতানিতে ধস
আবু হেনা মুহিব
সোনালি আঁশ খ্যাত পাটশিল্পের দুর্দিন চলছে। এক সময়ের প্রধান এ রফতানি পণ্য এখন আয়ের বিবেচনায় খাদের কিনারে এসে ঠেকেছে। চার বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। গত চার বছরে অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রফতানি আয় ক্রমে নিম্নমুখী। স্বাধীনতার পর পর দেশের রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশ এ খাত থেকে এলেও এখন পাটের অবদান কমতে কমতে ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। রফতানি আয় কমে যাওয়ার কারণে পাট উৎপাদনেও কৃষকের আগ্রহ নেই। ১ লাখ বেলেরও বেশি উৎপাদন এখন ৩৫ হাজার বেলেরও কম। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এক সময় পাটের উৎপাদন এবং রফতানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
পাট শিল্পের করুণ এ পরিণতির বিষয়ে রফতানিকারক এবং বাজার গবেষকরা বলছেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে এ অবস্থায় পড়েছে পাট খাত। বিগত কোনো সরকারই এই খাতে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়নি। সরকারি পাটকল বন্ধ করে দিতে বিশ্বব্যাংকের ভুল পরামর্শও দায়ী বলে মনে করেন তারা। এ ছাড়া পাটকে সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে এ শিল্পের বিকল্প পণ্য আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আইন করা হলেও পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি বলে তাদের অভিযোগ।
সরকারের ভুল নীতির ব্যাখ্যা করে জুট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম রেজা সমকালকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে রফতানিমুখী পাট ও পাট পণ্যের বেলায় সবচেয়ে বেশি শুল্ক আদায় করা হয়। এ কারণে বন্দর সেবা চার্জ দিয়ে রফতানি করে পোষানো সম্ভব হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে স্থলবন্দর দিয়ে একমাত্র ভারতেই রফতানি করতে হয়। ভারত এ সুযোগ নিয়ে যে দর দেয়, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছেন রফতানিকারকরা।
রেজা বলেন, দর কমতে কমতে ৮০০ ডলারের বেল এখন ৫০০ ডলারে নেমে এসেছে। অশুল্ক-আধা শুল্ক বাধা তো আছেই। ২৫ শতাংশ লোকের রুটি-রুজির জায়গা হলেও এ খাতের রফতানিতে প্রণোদনা দেওয়া হয় সবচেয়ে কম। আবার সব কৃষিপণ্য ১০ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ পেলেও পাটকে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। এসব মিলে উৎপাদন ১ লাখ বেল থেকে এখন ৩৫ হাজার বেলে কমে এসেছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে পাট ও পাটজাত রফতানি থেকে আয় এসেছে ৬৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ১৮ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অথচ চার বছর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরের একই সময়ে পাট ও পাটজাত রফতানি থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৯২ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।
পাট ও পাট পণ্য নিয়ে এক গবেষণায় সিপিডি বলেছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। এখন এই হার কমতে কমতে মোট রফতানি আয়ের ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাটের বিশ্ববাজার হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সিপিডি বলেছে, পাটের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক, সিনথেটিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, এর বিপরীতে পাটপণ্যে বৈচিত্র্য এবং গুণগত মান উন্নয়নে মনোযোগ ও দক্ষতার অভাব ছিল। তবে দেশে আগের মতোই এখনও বিশ্বের সেরা মানের পাট উৎপাদন হয়। সংস্থার জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশি-বিদেশি বাজার বর্তমানের কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে এ সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যয় সাশ্রয়ী করা হলে পাটের সুদিন ফিরে আসতে বাধ্য। সড়ক নির্মাণে বিটুমিনের সঙ্গে জিও টেক্সটাইল (পাটের পাতলা চট) ব্যবহার করা হলে অবকাঠামো মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। শ্রমঘন শিল্প হিসেবে পাট জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। এ জন্য আইন বাস্তবায়নসহ নীতি কার্যকর করতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।