Published in The Daily Inquilab on Thursday, 4 December 2014.
সরকার-ব্যবসায়ী মিলে চাল আমদানির হিড়িক
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
বেসরকারি খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি। এতে কৃষক, চালকল ও চাতাল মালিকরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। এভাবে চললে বাংলাদেশ শিগগিরই খাদ্য সংকটে পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতার পরিবর্তে দেশ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কারণ, দাম না পাওয়ায় কৃষক চাল উৎপাদন কমিয়ে দেবেন। পাশাপাশি চালকল মালিকরা চাল প্রক্রিয়াকরণ বাদ দিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়বেন।
ব্যাপকহারে চাল আমদানির জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধাকে দুষছেন চালকল মালিকরা। তারা বলছেন, সরকার আমদানিতে শুল্কারোপ করলেই আমদানি কমে যাবে। এতে দেশের কৃষক ও চালকল মালিকরা বাঁচবেন।
আমনের ভরা মৌসুমেও দেশে উৎপাদিত চালের তুলনায় আমদানি করা চালের দাম কেজিতে দুই-তিন টাকা কম। মুনাফা বেশি থাকায় ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন চাল আমদানির দিকে। আর এসব আমদানিকৃত চালের একটি অংশ যাচ্ছে সরকারের গুদামে। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক।
প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানি হওয়ায় দেশের কৃষক, চালকল ও চাতাল মালিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। আমদানি করা শুল্কমুক্ত চালের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পেরে অনেক এলাকার মালিক বন্ধ রেখেছেন তাদের মিল-চাতাল। এতে বেকার হতে বসেছেন শত শত চাতাল শ্রমিক। সর্বন্ত¦ান্ত হওয়ার পথে কৃষক।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গতকালের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১ জুলাই থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চাল আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে এই আমদানি ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ১৮ দিনেই আমদানি হয়েছে ৯৩ লাখ মেট্রিক টন। পরিস্থিতি এমন পর্যায় দাঁড়িয়েছে, দিন যত যাচ্ছে চাল আমদানির গতি তত বাড়ছে। একই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১ জুলাই থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারি খাতে আমদানি হয়েছে ৬৯ হাজার মেট্রিক টন।
এদিকে ব্যাপক হারে চাল আমদানি হলেও শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর প্রথম কিস্তি হিসেবে গতকাল ২৫ হাজার মেট্রিক টন চাল রপ্তানির চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে এটাই প্রথম চাল রপ্তানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমাদানি ঋণপত্রের প্রতিবেদনেও দেখা গেছে একই চিত্র। এতে দেখা গেছে, আগস্টে সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। সেপ্টেম্বরে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৩ কেটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ডলারের। আর অক্টোবরে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৩ কোটি ৯২ লাখ ৩০ হাজার ডলারের চাল আমদানির ঋণপত্র।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বেসরকারি পর্যায়ে কোনো ঋণপত্র নিষ্পত্তি করা হয়নি; এমনকি ঋণপত্র খোলাও হয়নি। সম্প্রতি চাল যা আমদানি হচ্ছে বেশিরভাগই সরকারি খাতে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে চাল আমদানির বিষয়টি বারবার অস্বীকার করা হচ্ছে।
গত অক্টোবরে এক সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, গত ৩ বছর ধরে কোনো দেশ থেকে আমাদের চাল আমদানি করতে হয়নি। কয়েকদিন আগে চাল আমদানির বিষয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ভারতের খাদ্যগুদামগুলোতে চালের মেয়াদ তিন বছর পার হলে তারা তা রপ্তানি করে দেয়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা গোখাদ্য হিসেবে তা আমদানি করছেন। দেশে চালের কোনো সংকট নেই বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চালের মজুদ কম আছে। মজুদ ঘাটতির সুযোগ কাজে লাগিয়েই ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করছেন। তারা বলছেন, দেশে ১৫ লাখ মেট্রিক টন চালের মজুদ দরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিদেনে দেখা গেছে, গতকালের চালের মজুদ ছিল ১০ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টন।
বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, গত দুই বছরে বোরোর উৎপাদন একই জায়গায় রয়েছে। অথচ এই সময়ে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে; বেড়েছে চাহিদা। সব কিছু হিসাব-নিকাশ করেই চাল আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি মজুদ আগের মতো নেই জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৫ থেকে সাড়ে ১৫ লাখ টন খাদ্য মজুদ থাকার কথা; চাল ও গম মিলিয়ে মজুদ আছে সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন। আমদানিকারকরা এ বিষয়টিও মাথায় রাখছেন বলে জানান তিনি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, খাদ্যশস্যের মজুদ দিন দিন কমছে। ১৯ নভেম্বর খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন। ১ ডিসেম্বর মজুদ কমে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টনে। ১২ দিনের মাথায় চালের মজুদও ১১ লাখ ৮ হাজার থেকে কমে ১০ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।
তবে চালের মজুদ কম থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত চাল-গম মজুদ রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানি করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু শুল্কমুক্ত সুবিধা ও ভারতে দাম সস্তা হওয়ায় সীমান্ত এলাকার একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে চাল আমদানি করছে। তবে এভাবে চাল আমদানি রোধে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি। তিনি বলেন, যখন আমাদের দেশে চালের সঙ্কট ছিল তখন বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করে। সে সুবিধা আর বন্ধ করা হয়নি। তবে এখন সময় এসেছে চাল আমদানিতে শুল্ক ধার্য করার। বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বসে চাল আমদানিতে শুল্কারোপের আবেদন করবেন বলে জানান তিনি।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার এবার আমন মৌসুমে ৩২ টাকা কেজি দরে তিন লাখ টন আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরাসরি মিলারদের কাছ থেকে এ চাল সংগ্রহ করা হবে। গত ১৫ নভেম্বর আমন সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে চাল সংগ্রহ অভিযান। খাদ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর প্রতিকেজি আমন ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ১৮ টাকা। প্রতিকেজি আমনের বিক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সা। প্রতিকেজি চাল উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ২৮ টাকা। সরকার এর ক্রয়মূল্য ১ টাকা বড়িয়ে নির্ধারণ করেছে ৩২ টাকা।
আমদানিকারকদের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিকেজি স্বর্ণা চাল আমদানির মূল্য পড়ছে ২৯ টাকা। আতব চালের কেজি পড়ছে ২৩ টাকা ৭৯ পয়সা। অথচ গতকাল দেশের খোলাবাজারে প্রতিকেজি স্বর্ণা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়। আর আতব চাল বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ টাকায়। আমদানি মূল্যের চেয়ে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি দরে চাল বিক্রি হচ্ছে দেশের বাজারে। এই বাড়তি লাভের আশায় মূলত চাল আমদানি বেশি করা হচ্ছে বলে জানান আমদানিকারকরা।
দেখা গেছে, ভারতের আমদানি করা প্রতিকেজি চালের মূল্যের তুলনায় সরকারি ক্রয়মূল্য প্রায় আড়াই টাকা বেশি। এই সুযোগে আমদানিকৃত চালের একটা অংশ ঢুকছে সরকারের গুদামে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির আহ্বায়ক হারুন-উর রশিদ জানান, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে চালের দাম কম হওয়ায় এবং কোনো আমদানি শুল্ক না থাকায় অধিক লাভের আশায় এখন ভারত থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। কেবল হিলি স্থলবন্দর দিয়েই এখন প্রতিদিন দুই হাজার টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। আর আমদানিকৃত এ চালের বড় অংশই চালে যাচ্ছে সরকারের গুদামে। ধান কিনে চাল তৈরি করে তারপর সরকারের কাছে বিক্রি করার চেয়ে ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল বিক্রি করতেই ব্যবসায়ীরা বেশি আগ্রহী।
এ বিষয়ে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের উপদেষ্টা মাহবুব হোসেন বলেন, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি আরও কমে আসবে। এতে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হারও ধরে রাখা কঠিন হবে। কৃষকের চেষ্টা ও সরকারি উদ্যোগের ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে বাংলাদেশ যে অগ্রগতির দিকে যাত্রা শুরু করেছিল তা বাধাগ্রস্ত হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কৃষক যাতে কোনোভাবে তার কষ্টের ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হয় সে দিকটি সবার আগে নজরে রাখা দরকার। কারণ, ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষক ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।