Published in Janakantha on Friday, 7 August 2015.
স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় আস্থা বাড়ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের
রহিম শেখ
বেশ কয়েকটি কারণে গেল বছরে বিদেশী বিনিয়োগ একেবারেই বাড়েনি। স্থানীয় বিনিয়োগও যেটুকু বেড়েছে তাও যতসামান্য। এর মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাজনৈতিক সংঘাতে অনেক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে এসেও ফিরে গেছেন। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় আবারও আস্থা বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের মনে। বিনিয়োগ করতে ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। একই সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশে আশার আলো দেখছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় মাসে বস্ত্র, সেবা, শিল্প ও কৃষিখাতে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ৬৩টি শিল্প ইউনিট। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বিদেশী বিনিয়োগের নিবন্ধনের হার ৮ শতাংশ বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বিনিয়োগ কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিনিয়োগ বোর্ডের হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে জুন ছয় মাসে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ২৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার বিনিয়োগ নিবন্ধন করেছেন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। গত বছর এই সময়ে বিনিয়োগ হয়েছিল ২১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সে হিসেবে ৮ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। একই সঙ্গে গত ছয় মাসে বিদেশী প্রকল্প নিবন্ধনের সংখ্যাও বেড়েছে। জানুয়ারি থেকে জুন এই সময়ে বিনিয়োগ বোর্ডে মাত্র ৬৩টি বিদেশী প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। আগের বছর একই সময়ে বিদেশী প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছিল ৬০টি। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের পরিমাণও বেড়েছে। বিদেশী কারখানাগুলোতে গত ছয় মাসে ২১ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। যেখানে গত বছর এই সময়ে বিদেশী কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছিল ১৩ হাজার শ্রমিকের।
বিদেশী প্রকল্পের নিবন্ধন এবং বিনিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বিদেশী বিনিয়োগ বাড়েনি। এর সঙ্গে অবশ্য অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা জড়িত। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বিদেশী উদ্যোক্তরা। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বিনিয়োগ কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতি মাসেই বিদেশী বিনিয়োগের হার বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিলÑজুন) সময়ে ১৪টি শতভাগ বিদেশী ও ১৫টি যৌথ বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত শিল্পে অর্থাৎ বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্বলিত মোট ৩৯টি নিবন্ধিত শিল্প ইউনিটের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৪৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর আগে বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারিÑমার্চ) সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্বলিত মোট ২৪টি নিবন্ধিত শিল্পের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এ সময়ে যৌথ ও শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এদিকে গত তিন মাসে সম্পূর্ণ স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত ৩৬৪টি শিল্প ইউনিটে প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ ৩১ হাজার ৭৩১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর আগে বছরের প্রথম তিন মাসে জানুয়ারিÑমার্চ সময়ে স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত ৩৩৬টি শিল্প ইউনিটে প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৫৯৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব বৃদ্ধি পেয়েছে ১০৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। প্রকল্প নিবন্ধন বেশি হওয়ার কারণে গত ছয় মাসে দেশী কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থানের হারও বেড়েছে। গত ছয় মাসে বিভিন্ন কারখানায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ৭৩ হাজার ৫২৪ জনের। আগের বছর এ সময়ে কর্মসংস্থান হয়েছিল ৫০ হাজার জনের। এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, গত ছয় মাসে বিদেশী বিনিয়োগের নিবন্ধন কিছুটা বেড়েছে। তবে এ হার আরও বাড়ত যদি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু না হতো। তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা একটি দেশে নির্বাচন হওয়ার পর কয়েক মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। নতুন গঠিত ওই সরকার নীতিতে কোন পরিবর্তন আনে কি-না বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে কি নাÑ এ সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরপর বিনিয়োগে গতি আসতে থাকে। বছরের বাকি সময় বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সূত্র মতে, মোবাইল ফোনের পাশাপাশি টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্য, রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিভিত্তিক শিল্প, কাঁচা পাট, কাগজ, রেশম শিল্প, হিমায়িত খাদ্য (বিশেষত চিংড়ি), পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিং এর মতো রফতানিমুখী শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারি ও তথ্য প্রযুক্তির শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও বিদেশী বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে যা দেশীয় আমদানি ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে। ইতোমধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাতে (ইপিজেড) যৌথ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। জানা গেছে, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ১৫টি সেবামূলক খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে ১৭টি খাতে। এছাড়া বিনিয়োগ করার পর সেই বিনিয়োগ সুরক্ষায় বিশ্বের ২২তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ইতোমধ্যে শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ হাই কমিশন ও মাইডাস টাচ এশিয়ার (এমটিএ) যৌথ উদ্যোগে আগামী ২৭ আগস্ট আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। তৃতীয় বারের মতো এই সম্মেলন শতভাগ সফল করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন।
জানা গেছে, দিনব্যাপী এ বিনিয়োগ সম্মেলনে এশিয়ার ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রেটিং এজেন্সি বা ঋণমান নির্ণয়কারীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় আড়াইশ’ বেশি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। এতে সরকারী কর্মকর্তা এবং কয়েকটি ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সম্মেলনে সমাপনী ভাষণ দেবেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বাংলাদেশের বিনিয়োগের সুযোগ, পণ্য রফতানিতে বৈচিত্র্য, শেয়ারবাজার, পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্পোরেট বাজার নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করছে সরকার। বিশেষ করে জমির স্বল্পতার কথা বিবেচনায় নিয়ে সেবা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কাজ করা হচ্ছে। এ সব খাতে বিনিয়োগের জন্য জমির খুব প্রয়োজন হয় না। বিষয়টি নিয়ে বিনিয়োগ বোর্ড কাজ করছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সঙ্গে কর্মসংস্থানের যোগসূত্র রয়েছে। তাই বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে ভারি ও বৃহৎ শিল্পকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এটি সরকারের এটি ভাল উদ্যোগ। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আনা নয়, বরং বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একটি জায়গায় হাজির করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। সে জন্য এই সম্মেলনটিকে একটি প্লাটফর্ম বলা যায়।