Published in Manabzamin on Saturday, 7 March 2015.
শঙ্কায় অর্থনীতি
হামিদ বিশ্বাস
টানা অবরোধের দুই মাস পার হয়েছে। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তারও কোন নিশ্চয়তা মিলছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি নিয়ে চরম শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। বিনিয়োগ ও শিল্প উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। তারা বলছেন, চলমান অবস্থা যতটা দীর্ঘায়িত হবে, অর্থনীতির ওপর চাপ ও ঝুঁকি তত বাড়বে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি উন্নতির কোন লক্ষণ নেই, বরং আরও অবনতি হতে পারে। সব ধরনের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আহরণ কমেছে। কমছে অভ্যন্তরীণভাবে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দোকান, মার্কেট ও শপিং মলে বেচাকেনা নেই। সেবা, যাতায়াত, পণ্য পরিবহনসহ অর্থনীতির সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সার্বিক অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, টানা হরতাল-অবরোধে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। সাধারণত অর্থনীতির উন্নয়নে দরকার দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিবেশ অনুকূলে নেই। এভাবে চলতে থাকলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে নিচে থাকবে, যা জনবহুল রাষ্ট্রের জন্য কিছুতে কাম্য নয়। বাংলাদেশের মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে তারা নিজেরা যা পারে করে, কারও অপেক্ষায় থাকে না। ছোট ও মাঝারি ধরনের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো একক চেষ্টায় বিভিন্ন শিল্প গড়ে। আর অসুস্থ রাজনীতি ও ক্ষমতাসীনরা তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। এখনও তার ব্যত্যয় ঘটছে না বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ হরতাল-অবরোধে মানুষ ভয়ের মধ্যে থাকে। এর মাঝেও অনেক কর্মকাণ্ড হচ্ছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কত হবে এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। কারণ অনেক খারাপ সময়েও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভাল থাকতে দেখা গেছে। সমাধানের পথ স্পষ্ট না হলেও রাষ্ট্রের মালিক যেহেতু জনগণ। সে কারণে জনগণের মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনা হতে পারে।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেছেন, টানা হরতাল-অবরোধে দেশ ও দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশী-বিদেশী খাতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হলে ভাল। সেজন্য দরকার খোলা মনে সব পক্ষকে এগিয়ে আসা। একটা সম্মানজনক সমাধান এখন সাধারণ মানুষও প্রত্যাশা করছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, দেশে দুই মাস ধরে অবরোধ কিছুতে কাম্য নয়। সরকার ও বিরোধী জোট ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ডে দেশে বিনিয়োগসহায়ক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ, ম্রিয়মাণ ও সংকোচিত হয়ে আসছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার ধরেছে ৭.৩ শতাংশ ও বাংলাদেশ ব্যাংক ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিবেশে এর কোনটিই অর্জন সম্ভব নয়। উৎপাদন সীমিত, কর্মসংস্থান সংকোচিত ও কর্মরত মানুষের ঘটছে কর্মচ্যুতি। সে কারণে এটি সম্ভব নাও হতে পারে। এ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকার বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। রয়ে যাবে দীর্ঘ মেয়াদে অস্থিরতার আশঙ্কা।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখ্ত বলেন, টানা হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যাতায়াত, ট্যুরিজমসহ বেশ কিছু খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সব ধরনের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় সবাই এক ধরনের ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও উত্তোলন সবই ব্যাহত হচ্ছে। সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ মুহূর্তে বড় বড় প্রকল্পে সরকারের নজর দেয়া উচিত। বিশেষত পদ্মা সেতুসহ ওই জাতীয় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করলে চলমান ক্ষতি দৃশ্যমান থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।