Published in Bonik Barta on Monday, 9 February 2015.
আক্রান্ত ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য
ইসমাইল আলী ও বদরুল আলম
ভারতে খাদ্য ও প্লাস্টিক পণ্য রফতানিকারক অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সঠিক সময়ে বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে পারছে না তারা। এজন্য অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। প্রাণের মতোই একই পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে, এমন অনেক প্রতিষ্ঠানকেই। এতে সামগ্রিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য।
চলমান হরতাল-অবরোধে বিঘ্নিত হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চলাচলকারী গুডস ট্রেনও বন্ধ রয়েছে এক মাস ধরে। বন্ধের পথে দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাস চলাচলও।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ভারতে রফতানি চালানগুলোর ক্ষেত্রে বন্দরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছানো জরুরি। ১০-১২টি রফতানি চালান একসঙ্গে হলেই কেবল সীমান্তের বন্দর কর্তৃপক্ষ সেগুলো ছাড়ের প্রক্রিয়া শুরু করে। একই নিয়ম অনুসরণ করতে হয় আমদানির ক্ষেত্রেও। তবে চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সময়মতো সীমান্তে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন না রফতানিকারকরা। ফলে ক্রেতাকে সময়মতো পণ্য বুঝিয়ে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। আবার আমদানি পণ্য সীমান্তে এলেও বন্দর থেকে ছাড় করানোর পর সঠিক সময়ে আমদানিকারক পর্যন্ত তা পৌঁছছে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সড়কপথনির্ভর বাণিজ্য হওয়ায় সবচেয়ে বড় অংশীদার হিসেবে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুলা, মসলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি করতে হয়। আবার রফতানির ক্ষেত্রে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। চলমান অস্থিরতায় আমদানি-রফতানি দুই ক্ষেত্রেই চালানে ড্যামারেজের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলমান অস্থিরতায় ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সঠিক সময়ে সীমান্তে পণ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিপুল পরিমাণ ড্যামারেজ দিতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছি।’
ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে মোট ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ১৪ লাখ ডলারের পণ্য। এর ১৬ শতাংশ বা ৬০৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পণ্য এসেছে ভারত থেকে। দেশটি থেকে আমদানি করা মূল পণ্যের মধ্যে আছে বস্ত্র খাতের সুতা ও তুলা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকে এ পণ্যগুলো আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪২ কোটি ১৪ লাখ ডলার।
তুলা আমদানির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভারত থেকে তুলা বা সুতা আমদানির ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবেই কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এর সঙ্গে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা।
বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশন অব এজেন্টস ট্রেডার্স গ্রোয়ার্স অ্যান্ড গিনার্সের সভাপতি মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তুলা ও সুতার মূল্য নিয়ে। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে তুলা ও সুতার মূল্য পড়ে যাচ্ছে। মোট তুলা আমদানির ৪০ শতাংশের বেশি হয় ভারত থেকে। ফলে মূল্য পড়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা দুই দেশের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বৃহৎ বাজার হলো ভারত। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩৩ হাজার ১৮ ডলার। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে এর পরিমাণ ২৯ কোটি ৪৬ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৪ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২১ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৯ ডলার। এ হিসাবে রফতানি বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থবছরের বাকি সময়গুলোয় প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে দেশের প্রধান স্থলবন্দরগুলো দিয়ে সাম্প্রতিক আমদানি-রফতানি চিত্রে। বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, স্বাভাবিক সময়ে এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন আমদানি হতো ৪০০ ট্রাক পণ্য। রফতানি পণ্য যেত ১৫০ ট্রাক। টানা অবরোধ ও হরতালে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দরটি দিয়ে আমদানি-রফতানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণেও এর প্রভাব পড়েছে।
বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গেল জানুয়ারিতে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৬৫২ ট্রাক পণ্য; দৈনিক গড়ে ২১৫ ট্রাক। রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৩৫৯ ট্রাক বা দৈনিক গড়ে ৪৫ ট্রাক। এছাড়া জানুয়ারিতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল ১৯৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। সেখানে আহরণ হয়েছে ১৭২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
বেনাপোল কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার আতিকুর রহমান বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আহরণে। তবে এ অবস্থা কেটে গেলে আবার কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন এ রাজস্ব ঘাটতি থাকবে না।
বাংলাহিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রের বরাত দিয়ে হিলি বন্দর প্রতিনিধি জানান, এ বন্দর দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে ১৪০-১৫০টি পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করত। অবরোধ ও হরতালের কারণে এখন আসছে ১০০-১১০টি ট্রাক।
হিলি স্থলবন্দর মূলত আমদানিনির্ভর বন্দর হলেও বন্দর দিয়ে মাঝে মধ্যে বেশকিছু পণ্য ভারতে রফতানি হয়। সেখানে বর্তমানে অবরোধ ও হরতালের কারণে ভারতে পণ্য রফতানি প্রায় বন্ধ বললেই চলে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শাকসবজি, প্রাণী ও অ্যানিমেল ফ্যাট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, মেটালিক পণ্যের মতো বেশকিছু অপ্রচলিত পণ্যের বাজার ভারত। এর মধ্যে বেশকিছু পচনশীল। তাই সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে এগুলো পচে নষ্ট হবে বা গুণগত মান কমে যাওয়ায় রফতানি মূল্য কম পাওয়া যাবে। আবার টেক্সটাইলের ইয়ার্নসহ বেশকিছু কাঁচামালের বড় উত্স ভারত। এর প্রভাব পড়বে শিল্প পণ্যে। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যও ভারত সরবরাহ করে। এগুলো আমদানি বিলম্বিত হলে দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভাড়া বেড়ে গেছে। পাশাপাশি ওয়েটিং চার্জও ব্যবসায়ীদের বহন করতে হচ্ছে। এর প্রভাবও পড়বে পণ্যের দামে। সার্বিকভাবে আমদানিকারক ও রফতানিকারক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাস চলাচল বন্ধ: বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঢাকা-আগরতলা বাস চলাচল দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। এ রুটে কোনো যাত্রীই পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো দিন দু-তিনজন নাম লেখান। এতে বাধ্য হয়ে প্রতিদিনই ট্রিপ বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়া চলমান অবরোধে ঢাকা থেকে কলকাতা রুটেও বাস চলাচল নিরাপদ নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশের তিন প্রতিষ্ঠান শ্যামলী, গ্রিন লাইন ও সোহাগ। যাত্রী না থাকায় প্রতিদিনের ১২টির পরিবর্তে দু-তিনটি বাস ছাড়া হচ্ছে।
জানা গেছে, গত এক মাসে ঢাকা-আগরতলা রুটে কোনো বাস চলাচল করেনি। তবে ঢাকা-কলকাতা রুটে মাত্র ছয়দিন চলে মৈত্রী বাস। একই অবস্থা অন্যান্য পরিবহনেরও।
শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, যাত্রী না থাকায় ঢাকা-আগরতলা রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ। মূলত নিরাপত্তার অভাবে যাত্রীরা এ রুটে যাতায়াত করছেন না। তবে ঢাকা-কলকাতা বাস আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় চালানো হচ্ছে। তবে ১২টির স্থানে চলছে মাত্র দু-তিনটি।
পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ: রেলপথে নাশকতার কারণে প্রায় এক মাস ধরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে রেলওয়ে। এর অংশ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ রুটগুলোয় প্যাট্রলিং ট্রেন চালু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমে একটি বগিবাহী ইঞ্জিন প্রথমে রেলপথ পরিদর্শন করে। এর পর মূল ট্রেন ছাড়া হয়। এতে অতিরিক্ত ইঞ্জিন প্রয়োজন হচ্ছে। তাই বন্ধ রাখা হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল।
সাধারণত সপ্তাহে ছয়টি পণ্যবাহী ট্রেন খুলনা থেকে বেনাপোল দিয়ে কলকাতা চলাচল করে। এছাড়া বিশেষ অর্ডার থাকলে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুট দিয়ে ভারতে পণ্যবাহী ট্রেন যাতায়াত করে। কিন্তু গত এক মাসে এ সার্ভিস পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। অনেকেই অর্ডার দিয়ে বসে আছেন। কিন্তু ইঞ্জিনস্বল্পতার কারণে ট্রেন চলছে না।