Published in Amader Shomoy on Sunday, 23 August 2015.
১৭৭টি এসএমই কাস্টারের স্থান চিহ্নিত
এবার চরাঞ্চলে হচ্ছে শিল্পনগরী
উদ্যোক্তারা বলছেন এতে বিনিয়োগে জমি সংকট দূর হবে
রুমানা রাখি
বাংলাদেশে বিনিয়োগে মূল সংকট ভূমির অভাব দূর করতে এবার নদীর বুকে জেগে ওঠা বড় চরাঞ্চলে শিল্পনগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথমে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর চরাঞ্চলে শিল্পপার্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে। ইতোমধ্যে চরগুলোতে জরিপ সম্পন্ন করে শিল্পনগরী স্থাপনের বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। চরের জমি ও খাস জমিতে কাস্টার বা মনোটাইপ শিল্পনগরী স্থাপন করে সেখানে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের বরাদ্দ দেবে সরকার। এজন্য ইতোমধ্যেই ৫১টি জেলায় ১৭৭টি এসএমই কাস্টার শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত বছরের ২৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। সভায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রী ও সচিব উপস্থিত ছিলেন।
ব্যবসায়ী ও গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের মূল বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভূমির অভাব। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমি সংস্থান করা সম্ভব হলেও অবকাঠামোগত সংকটের কারণে সকল স্থানে শিল্প স্থাপন করা যায় না। প্রয়োজনীয় জমি না পেয়ে ইতোমধ্যেই বিনিয়োগ করতে আসা অনেক উদ্যোক্তাই ফিরে গেছেন। এ অবস্থায় সরকার দেশি-বিদেশি শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ভূমি নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে সরকারের মালিকানাধীন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের অব্যবহƒত ভূমি বরাদ্দ দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়টি তদারকি করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ছয়টি অলাভজনক কারখানা চিহ্নিত করে তার ভূমি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য সার-সংপে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া প্লাস্টিক শিল্পনগরী ও মুদ্রণ শিল্পনগরীর জন্য আলাদা দুটি স্থান চিহ্নিত করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বিসিক।
প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশব্যাপী জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে সরকার ৫১টি জেলায় ১৭৭টি এসএমই কাস্টার শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য স্থান চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে কারুপণ্য সামগ্রীর জন্য ৩৮টি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প খাতের জন্য ৩৪টি, হাল্কা প্রকৌশল শিল্প খাতের জন্য ৩১টি, নিটঅয়্যার ও রেডিমেড গার্মেন্টস খাতের জন্য ২২টি, ডিজাইন ও ফ্যাশনঅয়্যার খাতের জন্য ১৬টি, চামড়াজাত সামগ্রীর ১৩টি, তাঁত শিল্প খাতের জন্য ১০টি, স্বাস্থ্যসেবা ও ডায়াগনস্টিক শিল্প খাতের জন্য পাঁচটি, বৈদ্যুতিক সামগ্রী খাতের জন্য তিনটি, প্লাস্টিক ও অন্যান্য সিনথেটিক্স শিল্প খাতের জন্য তিনটি এবং শিল্পসেবা খাতের জন্য দুটি কাস্টার স্থাপন করা হবে।
এসব কাস্টারগুলোর ৩৮ শতাংশ ঢাকা বিভাগে, ১৮ শতাংশ রাজশাহী বিভাগে, ১৫ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে, ১২ শতাংশ খুলনা বিভাগে, ৭ শতাংশ রংপুর বিভাগে, ৬ শতাংশ বরিশাল বিভাগে এবং বাকি ৪ শতাংশ সিলেট বিভাগে স্থাপন করা হবে। তবে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৩ জেলায় কোনো কাস্টার এখনো গঠন করা হয়নি। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- নেত্রকোনা, রাজবাড়ি, নড়াইল, মেহেরপুর, লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি।
এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানান, ১৭৭টি এসএমই কাস্টারের মধ্যে প্রায় ৪০টির উন্নয়ন চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। বাকিগুলোর চাহিদা নিরূপণের কাজ চলছে। পরে প্রতিটি কাস্টারের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে, যা স্বল্প মেয়াদে (১-৩ বছরের মধ্যে), মধ্যমেয়াদে (৩-৫ বছরের মধ্যে) এবং দীর্ঘমেয়াদে (৫ বছরের অধিক) বাস্তবায়ন করা হবে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব কাস্টার কিংবা শিল্পনগরীর প্রকল্প দলিলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরণ থাকছে। বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিকের ৭৪টি শিল্প নগরীতে মোট ৫ হাজার ৭৭৩টি শিল্প প্লটের মধ্যে ৫৭৩টি (১০.০৭ শতাংশ) প্লট নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণের অনুমোদন দেওয়া আছে। অবশিষ্ট ৫ হাজার ২০০ শিল্প প্লট পুরুষ উদ্যোক্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্লটে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানায় ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৩২ জন শ্রমিক কর্মরত আছেন, যার মধ্যে পুরুষ কর্মী ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৫৭ জন এবং নারী কর্মী ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৫ জন।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, সরকার বিভিন্ন খাতে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে টানতে আগ্রহী। সেজন্য বিশ্বের নামিদামি ব্রান্ডগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ভূমি ও বিভিন্ন পরিসেবা নিশ্চিত করবে সরকার। ১০টি খাতে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি কাজ করছে। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষিভিত্তিক শিল্প খাত, জাহাজ নির্মাণ ও পরিবেশসম্মত জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, পর্যটনশিল্প, আইসিটি পণ্য ও আইসিটিভিত্তিক সেবা, ফার্নিচার শিল্প, অটোমোবাইল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, হসপিটাল মেশিন ও ইকুইপমেন্টস, গার্মেন্টস মেশিন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পাট ও পাটজাতপণ্য।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আমাদের সময়কে বলেন, এটা খুবই কার্যকারী উদ্যোগ। এর ফলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিঘটিত যে সমস্যার কথা বিনিয়োগকারীরা বলেন তা হয়তো দূর হতে পারে। তবে কতটুকু বিনিয়োগ হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিনিয়োগ কম হওয়ার পেছনে একমাত্র ভূমিই কারণ নয়। রয়েছে অবকাঠামোগত অন্যান্য অনেক সমস্যা। তাই নতুন করে বিনিয়োগের জন্য প্লট বরাদ্দ দিলে সেইসব অবকাঠামোগত জটিলতা দূর করে শিল্প মালিকদের দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি।
বিসিকের বরাদ্দকৃত জমি শুধু অবকাঠামোগত জটিলতার কারণে বিনিয়োগের অভাবে খালি পড়ে আছে এমনটা উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবদি বলেন, বিসিকের অনেক জমি গ্যাস, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তা না পেয়ে উদ্যোক্তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সেই রকমভাবে নতুন জমির ক্ষেত্রে এমন অসুবিধা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার জন্যও সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
ভূমির সমস্যা দূর হলে অন্য সমস্যাগুলোও দূর হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ। তিনি বলেন, অবকাঠামোগত জটিলতার মধ্যে প্রথমেই ছিল ভূমি। তাই নতুন করে এমন উদ্যোগ স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও আকৃষ্ট করবে। ফলে দেশে ব্যবসায়িক গতি বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।