Published in Prothom Alo on Wednesday, 10 June 2015.
আবুল হাসনাত
দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে আছে। কোনোভাবেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। অথচ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে হবেই।
এর মধ্যেও যে দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নামেনি, সে জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারে। কারণ, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার নিজেই বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির স্বার্থে জোড়াতালি দিয়ে বিনিয়োগের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার।
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগে গতি আসে। কিন্তু গত পাঁচ বছর সরকারি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না।
কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং এখনো ঠিকমতো সংযোগ না পাওয়ায় অনেকে বিনিয়োগ প্রকল্প হাতে নিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছেন। এর সঙ্গে আছে অনুন্নত অবকাঠামো। আর বেশি ভোগাচ্ছে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার।
জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কেন হচ্ছে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ ব্যাংকঋণের চড়া সুদের হার। এটাকে যদি এক অঙ্কের ঘরে রাখা যায় তাহলে বিনিয়োগ এমনিতেই বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে লাগবে শিল্পে বিদ্যুতের সংযোগ।
স্থানীয় বিনিয়োগে গতি নেই: অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫ অনুযায়ী, দেশে এখন বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগের হার ছিল ২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। চার বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে পৌনে ১ শতাংশ।
২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশ ছাড়ায় (২২ দশমিক ১৪ শতাংশ)। পাঁচ বছর পর এখনকার বিনিয়োগের হার ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কতটা নাজুক পরিস্থিতিতে আছে।
অথচ এই পাঁচ বছরে সরকারি বিনিয়োগ দেড় শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিবছরই বাড়ছে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার। আগামী অর্থবছর এডিপির আকার ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগের হার যেখানে ছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, সেখানে এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশে।
সাধারণত সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামো খাতেই বেশি বিনিয়োগ করে। এসব ক্ষেত্রে উন্নতি হলে ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগে আগ্রহ পান।
কিন্তু সরকারি বিনিয়োগ কেন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না, জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি বিনিয়োগ মূল্যের দিক থেকে বাড়লেও গুণগত মানের দিক থেকে কমছে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগছে, ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো থেকে বেসরকারি খাতের যতটা সুবিধা পাওয়ার কথা ততটা পাচ্ছে না। আবার অনেক বড় প্রকল্প কয়েক বছর ধরে চলছে। সে কারণে অনেক প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগ হয়, কিন্তু সেখান থেকে সুফল আসে না। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু বরাদ্দ চলছে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে বিনিয়োগ বোর্ডে ৮১৯টি দেশীয় বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রস্তাব জমা পড়েছে। এতে বিনিয়োগ হবে ৪৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আগের বছর বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা পড়ে ১ হাজার ৩০৮টি (৪৯ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকার)।
নিবন্ধিত স্থানীয় বিনিয়োগের মধ্যে ঠিক কতগুলো বাস্তবায়িত হয় তার কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিনিয়োগ বোর্ডের নমুনা জরিপ বলছে, দেশীয় বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রায় ৬৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়।
বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। এর আগের বছর বিনিয়োগে পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৯৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ এফডিআই কমেছে।
দুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত বিনিয়োগ পরিবেশসংক্রান্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনেক সমস্যার সমাধান করতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। তবে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, আমলতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতি বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাও এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কম হওয়ার জন্য জমির স্বল্পতাকেও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।