রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগে ভাটা এবং ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কারসাজির বিচার শুরু হওয়ায় একটি চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। ফলে বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম নিয়ে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিচার যদি স্বচ্ছ হয় তবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ‘স্ট্রং মেসেজ’ আসবে। পাশাপাশি বাজার আরো পরিপক্ক হবে। যা দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে সুফল বয়ে আনবে।
Published in Manobkantho on Monday, 2 November 2015.
পুঁজিবাজার দিনে হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার পুঁজি
মাহফুজুল ইসলাম
পুঁজিবাজার দিনে হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার পুঁজিমহাধসের ৫ বছরেও স্থিতিশীল হয়নি দেশের পুঁজিবাজার। উল্টো এ সময়ে ফেসবুক, মোবাইলসহ বিভিন্নভাবে বাজারে গুজব ছড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পুঁজি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। পুঁজিবাজারে গত মাসে লেনদেন হয়েছে ২৩ দিন। এর মধ্যে ১৬ দিন বাজারে দরপতন হয়েছে। সর্বশেষ সপ্তাহজুড়ে দরপতন অব্যাহত ছিল। সব মিলে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত পুঁজিবাজার থেকে ২১ হাজার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকার বাজার মূলধন নাই হয়ে গেছে। যা গড়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার মতো। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ইতালি ও জাপানের নাগরিক খুন হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশিদের পাশাপাশি দেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক এমনকি বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই কম দামে শেয়ার বিক্রি করছেন। অন্যরা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। এসব দেখে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে পড়েছেন। তারা সঞ্চয়ের সব অর্থ হারানোর ভয়ে কেনা দামের চেয়ে কম দামে শেয়ার বিক্রি করছেন। ফলে প্রতিদিনই বাজার থেকে নাই হচ্ছে হাজার কোটি টাকার মূলধন। এ ছাড়াও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কোম্পানির আইপিও’র অনুমোদন দেয়ায় নতুন করে বাজার থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেয়ায় তারল্য সংকটে পড়েছে বাজার বলে মনে করেন তারা।
শেষ মাসের সার্বিক বাজার পরিস্থিতি : গত ২৮ সেপ্টেম্বর ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২১ হাজার ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৯০ কোটি ৭৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এ সময়ে ডিএসই’র প্রধান সূচক গত ২৮ সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৩০১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৬৪ পয়েন্টে। আগের মাস সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৪ হাজার ৮৬৬ পয়েন্ট। ওই দিন লেনদেন হয়েছেছিল ৩৯৫ কোটি টাকা। আর গত সপ্তাহে লেনদেন হয়েছে গড়ে ২শ’ কোটি টাকা।
ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ : পুঁজিবাজারে বতর্মানে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ সমন্বয়ের সর্বশেষ সীমা ২০১৬ সালের ২১ জুন। এ কারণে ব্যাংকগুলো চাপে শেয়ার বিক্রি করছে। ফলে সমন্বয়ের মেয়াদ না বাড়ালে শেয়ারবাজার আরও খারাপ হবে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই সীমা আরও ৪ বছর বাড়াতে ডিএসই এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ছিল মোট দায়ের ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো এই সীমা অতিক্রম করে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে বিনিয়োগ কমিয়ে আনা হলে বাজারে বিপর্যয় হয়। এরপর ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকের বিনিয়োগ ইক্যুইটির ২৫ শতাংশ করা হয়। আর ইক্যুইটির মধ্যে রয়েছে পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ রিজার্ভ এবং অবণ্টিত মুনাফা। এতে আগে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা ১ হাজার কোটি টাকা থাকলে বর্তমানে তা ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। আর অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের মেয়াদ ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়। এ কারণে বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ব্যাংকগুলো চাপে রয়েছে। প্রতিদিনই ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সবার অভিমত : পুঁজিবাজারে সার্বিক বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসই’র সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী মানবকণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি বিদেশি নাগরিক হত্যায় বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এছাড়াও শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের মেয়াদা বাড়ানো হবে কিনা- তা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কায় রয়েছেন। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক সময় না বাড়ায় তবে ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের হাতে থাকা অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করবে। ফলে বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগে ভাটা এবং ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কারসাজির বিচার শুরু হওয়ায় একটি চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। ফলে বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম নিয়ে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিচার যদি স্বচ্ছ হয় তবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ‘স্ট্রং মেসেজ’ আসবে। পাশাপাশি বাজার আরো পরিপক্ক হবে। যা দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে সুফল বয়ে আনবে।
সাম্প্রতিক সময়ের দরপতন অপ্রত্যাশিত বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জাপানি ও ইতালির নাগরিক হত্যার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ছেন। এ পরিস্থিতিতে আইসিবিসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা মার্কেট সাপোর্ট না দিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন।
ডিএসই’র সাবেক পরিচালক ও মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন বলেন, বর্তমান বাজারের অবস্থাকে ইতিবাচক বলা যায়। কারণ অনেক মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম যৌক্তিক দামের নিচে রয়েছে। তবে শেয়ারবাজার যেহেতু একটি স্পর্শকাতর তাই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে কেনো আঘাত আসলে শেয়ারবাজারে তার প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাজার কিছুটা থমকে গেছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, নতুন নিয়মনীতি আর পূর্বের শেয়ার কেলেঙ্কারির কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থার সংকট রয়েছে। বড় বিনিয়োগকারীরা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। তারপরও সরকার এবং বাজারসংশ্লিষ্টরা বাজারকে স্থায়ীভাবে স্থিতিশীলতায় ফেরাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।