Published in Bonik Barta on Sunday, 26 July 2015.
যুক্তরাজ্যে ভালো নেই বাংলাদেশী অভিবাসীরা
মনজুরুল ইসলাম
পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক নাজমুস সাকীব উচ্চশিক্ষা ও ভালো চাকরির উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। পাঁচ বছর সে দেশে থেকে ২০১৪ সালে ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি। যুক্তরাজ্যের মাঝারি মানের একটি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে পারলেও ভালো কোনো চাকরি জোটেনি তার। বিভিন্ন ফুডশপে অল্প মজুরিতে চাকরি করে টিকে থাকলেও সাকীব যুক্তরাজ্যে স্থায়ী হতে পারেননি। বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন। শুধু সাকীবই নন, এমন পরিণতি হয়েছে অনেকেরই। আর যারা টিকে আছেন, তারা কাছের ও দূরের অন্যান্য দেশের অভিবাসীর তুলনায় নিম্ন জীবনমান নিয়েই টিকে আছেন।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের এমনই চিত্র উঠে এসেছে ‘মাইগ্রেশন ওয়াচ ইউকে’র গবেষণায়। ‘ইকোনমিক ক্যারেক্টারিস্টিকস অব মাইগ্রেন্টস ইন দ্য ইউকে ইন ২০১৪’ শীর্ষক এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেনে দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন মজুরি পেয়ে আসছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা, যাদের একটি বড় অংশের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা সে দেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের চেয়ে ৮০ শতাংশ কম বেতন পান। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিবাসীরা কর্মক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের সমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এমনকি কর্মসংস্থান ও মজুরিপ্রাপ্তির সূচকে আফ্রিকার দেশগুলোও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে অভিবাসী বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি নাগরিকরা সুযোগ-সুবিধা ও মজুরিপ্রাপ্তিতে একই কাতারে অবস্থান করছেন। এ দুই দেশের অভিবাসীরা কর্মক্ষেত্রে মজুরি যেমন সবচেয়ে কম পান, তেমনি এদের কর্মসংস্থানের হারও সবার চেয়ে কম। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও দাবি আদায়ের ক্ষেত্রেও দুর্বল অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশী অভিবাসীরা।
কাজের ধরন বিচার করলেও যুক্তরাজ্যের স্থানীয়দের তুলনায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশী অভিবাসীরা। খণ্ডকালীন চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিবাসীরা ব্রিটিশ বংশোদ্ভূতদের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও পূর্ণকালীন চাকরির ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো চিত্র। মাইগ্রেশন ওয়াচ ইউকের গবেষণায় দেখা যায়, পূর্ণকালীন চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফ্রিকার অভিবাসীদের অবস্থান তালিকার একদম নিচে। যদিও সংখ্যায় বেশি হওয়ায় পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর অভিবাসীরা ব্রিটিশ নাগরিকদের চেয়ে পূর্ণকালীন চাকরিতে বেশি সুযোগ পান।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব বাংলাদেশী সে দেশে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন, তারা বেশ ভালো রয়েছেন। তাদের আয় ব্রিটিশদের চেয়েও বেশি। তবে সার্বিকভাবে ব্রিটেনে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সংগ্রামরত বাংলাদেশীর সংখ্যাই বেশি। যারা নব্বইয়ের দশকে সে দেশে পাড়ি দিয়েছেন, তারা সহজেই অভিবাসন বৈতরণী পাড়ি দিতে পেরেছেন। অবশ্য এদের বেশির ভাগই ব্রিটেনে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত হয়েছেন। যেসব বাংলাদেশী বিনিয়োগ দেখিয়ে ব্রিটেনে অভিবাসী হয়েছেন, তারা ধনীদের কাতারে রয়েছেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে যারা দেশটিতে পাড়ি দিয়েছে, তারাই মূলত বিপাকে রয়েছেন। কারণ ব্রিটেনের অভিবাসন আইন অনুযায়ী, কেউ কমপক্ষে ১০ বছর সে দেশে বসবাস করলে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ পেতে পারে। এ কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্রিটেনের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নিয়েছেন। আর দেখা গেছে, এ বিনিয়োগের অর্থ জোগান দিতে গিয়ে দেশে তাদের জমি বিক্রি, বন্ধক রাখা অথবা ঋণ নিতে হয়েছে। এখন এ ঋণ শোধ করতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হচ্ছে অনেককে।
‘মাইগ্রেশন ওয়াচ ইউকে’র গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের শ্রমবাজারে বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি কর্মীর সংখ্যা মোট ৬ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। আর আফ্রিকা থেকে যাওয়া অভিবাসী রয়েছেন প্রায় ১০ লাখ। অভিবাসী বাংলাদেশী পুরুষদের মাত্র ৩২ শতাংশ পূর্ণকালীন চাকরি করছেন; বাকিরা হয় বেকার, নয়তো আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। সে তুলনায় ভারতীয় অভিবাসী পুরুষদের মধ্যে ৬২ শতাংশের বেশি পূর্ণকালীন চাকরি করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশী নারী অভিবাসীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ পূর্ণকালীন চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন, যেখানে ভারতীয় নারী অভিবাসীদের ৩০ শতাংশই পূর্ণকালীন চাকরি করছেন।
ব্রিটেনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আইনজীবী ব্যারিস্টার এম ইশতিয়াক হাসান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক শ্রেণীর মানুষ ব্রিটেনে খুব ধনী। তবে বেশির ভাগ মানুষকেই সেখানে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকার অন্যতম কারণ হলো— অনেকে সরকারের কাছ থেকে মাসিক ভাতা পেতে কৌশলী হয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। দক্ষ না হওয়ায় চাকরির বাজারে তারা পর্যাপ্ত মজুরি পাচ্ছেন না। এদিকে প্রতিনিয়ত পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়ছে না। এছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয়ে যারা রয়েছেন, দক্ষতার অভাবে তারা কাজ পান না। সব মিলিয়েই ব্রিটেনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের অনেককেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে হচ্ছে।
তবে অদক্ষতার পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্কের দুর্বলতাকেও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য দুষলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে চাকরির বাজারে এখনো দক্ষ মানুষ ধরে রাখার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। ফলে নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে তারা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে চাকরি পেতে যে যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক প্রয়োজন, তাতে বাংলাদেশীরা অনেক পিছিয়ে। সে দিক দিয়ে ভারতীয়রা অনেক শক্তিশালী অবস্থানে। কারণ যুক্তরাজ্যে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের তুলনায় ভারতীয়দের ইতিহাস অনেক পুরনো। তাদের অনেকেই সে দেশে বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যেখানে ভারতীয় নাগরিকরাই প্রাধান্য পাচ্ছেন।