Published in Kaler Kantho on Wednesday, 7 January 2015.
চামড়ায় মোড়ানো সমৃদ্ধি
ফারজানা লাবনী
প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশের গবাদি পশুর চামড়া গুণগত মানে অনেক উন্নত। আবার কম খরচে পণ্য উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে এ দেশে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের চামড়া খাতের ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। চামড়া খাত থেকে রপ্তানি আয় প্রতিবছরই বাড়ছে। আবার শ্রমঘন শিল্প হিসেবেও বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে চামড়া খাতের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে অর্থনীতিতে। অথচ কিছু সমস্যার কারণে চামড়াশিল্পের এ সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। চামড়াশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, চলমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো চামড়া খাতেও বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব বাণিজ্যে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। সেদিন খুব দূরে নয়।
চামড়া খাতের সম্ভাবনা : বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী বেসরকারি খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্র্যান্ডে স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে চলেছে। প্রতিবছরই বাড়ছে চমড়া খাতের রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর এ পাঁচ মাসে চামড়া খাতে রপ্তানি হয়েছে ৪৬৩ মিলিয়ন ডলার। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪৪৪ মিলিয়ন ডলার। এ দেশের গরু, ছাগল, মহিষসহ অন্যান্য প্রাণীর চামড়া প্রাকৃতিক কারণেই পুরু, তৈলাক্ত এবং উজ্জ্বল। এসব চামড়া দিয়ে পণ্য তৈরি করলে তা হয় দীর্ঘস্থায়ী, দৃষ্টিনন্দন। আবার প্রক্রিয়াজাত চামড়ার মানও হয় ভালো।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষিকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই ঘরে ঘরে গবাদি পশু পালন করা হতো, এখনো কমবেশি হয়। আবার নব্বই দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে গবাদি পশু পালন বেড়েছে। তাই সারা বছরই সহজে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সুযোগ পান ব্যবসায়ীরা। তবে চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরেও এটা বাড়ে। এভাবে প্রতিবছর গড়ে ২২০ মিলিয়ন বর্গফুট পশুর চামড়া সংগ্রহ সম্ভব হয় দেশের ট্যানারিগুলোতে।
পাঁচ বছর আগেও আন্তর্জাতিক চামড়ার বাজারের শতকরা ৫৫ ভাগ সরবরাহ হতো চীন থেকে। কিন্তু এ হিসাবে এসেছে পরিবর্তন। চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী দেশে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। ওই সব দেশের পণ্যের দাম বাড়লেও বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়াজাত এবং প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়েনি। ওই সব দেশে কারখানা আছে- এমন অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগের সন্ধান করছে। তারা উৎপাদন খরচ কম হবে- এমন দেশে গড়ে তুলতে চায় চামড়া শিল্পের নতুন কারখানা।
বাংলাদেশে এখনো বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি কম। তাই কম খরচে পণ্য উৎপাদনে অ্যাডিডাস, নাইকির মতো বড় বড় কম্পানি বাংলাদেশে এসে ভিড় জমিয়েছে। এখানে কারখানা নির্মাণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তারা।
এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণেও চীনের ওপর চামড়া খাতের নির্ভরশীলতা কমাতে তৎপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং তাদের সহযোগী দেশ। এসব দেশের পছন্দের তালিকার শীর্ষেই আছে বাংলাদেশ। এভাবে গত দুই বছর থেকে চীনের বিকল্প বাজার হিসেবে বিশ্ববাণিজ্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
তাই চামড়া খাতে বাংলাদেশের সোনালি ভবিষ্যৎ খুব দূরে নয়। তৈরি পোশাক শিল্পের মতো বাংলাদেশও চামড়া খাতে নেতৃত্ব দেবে বিশ্ববাজারে।
চমড়া খাতে বাংলাদেশে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান অ্যাপেঙ্ ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান মঞ্জুর এলাহী কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় কম খরচে চামড়া খাতে উৎপাদন করা সম্ভব। চামড়া খাতের প্রধান কাঁচামাল কাঁচা চামড়ার প্রচুর সরবরাহ রয়েছে এখানে। গুণগত মানের দিক থেকেও তা সেরা। তাই চীনসহ অন্যান্য দেশের পণ্যের দাম বাড়ায় সবাই এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ চামড়া খাতে আন্তর্জাতিক বাজারে শীর্ষ দেশ হিসেবে অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারবে।
আছে অনেক সমস্যা : বাংলাদেশের চামড়া খাতে অপার সম্ভবনা থাকলেও তা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না বিরাজমান কিছু সমস্যার কারণে। চামড়া খাতে কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে কঠোর অবস্থানে থাকে উন্নত বিশ্ব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে পরিবেশসম্মত কারখানায় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন না করলে বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেবে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইনিয়নভুক্ত দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ। জিএসপি বাতিলের পর চামড়া খাতে এ ধরনের নিষেজ্ঞাধা হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। ইতিমধ্যে চামড়া খাতের বিদেশি কম্পানিগুলো বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে।
প্রথম অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকার বিভিন্ন পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা স্থানান্তরে সময় বেঁধে দেয়। বাংলাদেশ সরকারের দেনদরবারে এ সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ট্যানারি স্থানান্তর সম্ভব না হলে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে দেওয়া হবে নিষেধাজ্ঞা।
আন্তর্জাতিক এসব বিধিনিষেধের প্রায় সাত বছর আগেই পরিবেশবাদী সংস্থা ‘বেলা’র দায়ের করা মামলায় হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে আদালতের নির্দেশ ছিল। কিন্তু সরকারের অদক্ষতা এবং চামড়া খাতের ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতায় হাজারীবাগের দূষিত পরিবেশ থেকে ট্যানারি সরিয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণ সম্ভব হয়নি। এখন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় টনক নড়েছে সবার।
অতীতে সরকার কারখানা সারানোর বিষয়ে এগিয়ে এলে ট্যানারির মালিকরা কারখানা নির্মাণে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। গত পাঁচ বছর বিষয়টি ঝুলে থেকে ২০১৪ সালে ক্ষতিপূরণের অর্থ এসে পৌঁছেছে ট্যানারির মালিকদের হাতে। অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে কারখানা সরিয়ে নিতে অঙ্গীকার করলেও কথা রাখেনি ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ ব্যবসায়ীরা অক্টোবরের মধ্যে কারখানা সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে সরিয়ে নেওয়ার কথা বললেও এ বিষয়ে ন্যূনতম প্রস্তুতি নেয়নি সে সময়ে। এরই মধ্যে ট্যানারির মালিকরা অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে নতুন দাবি জানিয়েছে। তারা আবেদনে উল্লেখ করে, নতুন কারখানা নির্মাণে ন্যূনতম এক বছর বা এর বেশি সময় প্রয়োজন হবে। এই দীর্ঘ সময় কারখানা বন্ধ রেখে ফের উৎপাদনে যেতে অর্থ সংকটে পড়বে ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা হারাবে। তাই স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সরবরাহ করা হলে চামড়া ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালিয়ে যেতে সমস্যায় পড়বে না।
অর্থ সংকটে ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়া বিলম্ব হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য ও জুতা প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি নাসিম মঞ্জুর কালের কণ্ঠকে বলেন, চীনের বিকল্প বাজার হিসেবে যে সময়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে, ঠিক সে সময়ে উন্নত দেশগুলো পরিবেশের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক নামিদামি কম্পানি বাংলাদেশের অনেক চামড়া ও চামড়াজাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দিয়েছে, পরিবেশসম্মত কারখানায় উৎপাদন না করলে বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কিনবে না তারা। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান চামড়া খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে আসছে না। তারা ভারতে চলে যাচ্ছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো কথা নয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে পরিবেশসম্মত গ্রিন ট্যানারি স্থাপনে সুপারিশ জানিয়ে চামড়া খাতের এই শীর্ষ ব্যবসায়ী বলেন, ব্যবসায়ীরা চায় না তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাক। তারা অচিরেই সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরে আগ্রহী। সরকারের দেওয়া ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে তারা কারখানা নির্মাণ করবে। কিন্তু কারখানা স্থানান্তরে যে ন্যূনতম এক বছর বা এর বেশি সময় প্রয়োজন হবে, এই দীর্ঘ সময় ব্যবসা বন্ধ রেখে আবারও উৎপাদনে যেতে অর্থের প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হলে ট্যানারি মালিকরা সংকট কাটাতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন তিনি।
গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান- এ দুই যেন এক সুতায় গাঁথা। কিন্তু আবহমান বাংলায় এসেছে পরিবর্তন। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। গোলা ভরা ধানের জন্য এখন আর গোয়াল ভরা গরুর প্রয়োজন হয় না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কৃষিকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই মূলত এ দেশে প্রান্তিক কৃষকের ঘরে ঘরে গরু, মহিষ পালন হয়ে আসছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সরকার নানাভাবে উৎসাহিত করছে। এতে কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছে। ফলে গবাদি পশুর ব্যবহারে আগের মতো উৎসাহী হচ্ছে না তারা। তাই অদূর ভবিষ্যতে চামড়াশিল্পের কাঁচামাল কাঁচা চামড়ার সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
চামড়া সংরক্ষণে রেখে তা ধীরে ধীরে কারখানায় ব্যবহার করা হয়। ট্যানারিগুলোতে চামড়া সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে পুরনো পদ্ধতি। এতে চামড়ার গুণগত মান দ্রুত কমতে থাকে। ফলে দাম কম পায় ব্যবসায়ীরা। আবার পণ্য বৈচিত্র্যকরণেও এ দেশের কারখানাগুলো পিছিয়ে আছে। মূলত ক্রেতাদের দেওয়া ডিজাইন অনুযায়ী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ কারখানাগুলো।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশেরই প্রশিক্ষণ নেই। এতে কারখানায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয় না। আবার অল্প কিছু কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হলেও অধিকাংশই চলছে পুরনো যন্ত্রপাতিতে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল প্রোডাক্টটিভিটি অর্গানাইজেশনের গবেষণায় পাওয়া তথ্যানুসারে, চামড়া খাতে অদক্ষ শ্রমিকের কারণে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। আবার পুরনো যন্ত্রপাতিতে জ্বালানি খরচসহ অন্যান্য খরচ বেশি হয়। লোকবল বেশি লাগে। এতে কারখানার ব্যয় বেড়ে গেলেও উৎপাদন কমে যায়। এ দেশে চামড়া খাতে প্রায় ৩০০ কারখানা রয়েছে। আবার এ খাতের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। কিন্তু ব্র্যান্ডেড পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা নেই এ দেশের চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের বেশির ভাগ কারখানার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট (ওইএম)’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে এ দেশের বেশির ভাগ চামড়া খাতের কারখানা। এসব কারখানা ডিজাইন, মানবসম্পদ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, কারখানার পরিবেশসহ কোনো ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণে সক্ষম নয়। এ ধারা থেকে বের হয়ে ওরিজিনাল ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট (ওডিএম) ক্যাটাগরিতে পৌঁছতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করে বাংলাদেশ অ্যাপেঙ্ ফুটওয়্যার লিমিটেড ওডিএম ক্যাটাগরিতে আছে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজস্ব ব্র্যান্ডে পরিচিত।
এ দেশের চামড়া খাতের কারখানায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। এতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। তাই উন্নত দেশগুলো থেকে শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মানসম্মত পরিবেশে ও মজুরিতে শ্রমিককে না ঠকিয়ে, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বজায় রেখে চামড়া খাতের কারখানাগুলোতে কাজ করার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট খাতের কারখানাগুলো কালো তালিকাভুক্ত হবে। এতে এসব কারখানা থেকে পণ্য কেনা বন্ধ করে দেবে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ।
অনুন্নত অবকাঠামো ও জ্বালানি সংকটে সংশ্লিষ্ট খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকঋণের চড়া সুদে চামড়া খাতের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে লোটো বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এক্সপ্রেস লেদার প্রোডাক্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জামিল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবেশী ভারতে চামড়া খাতের জন্য রয়েছে ব্যাংকঋণে সহজ শর্ত এবং স্বল্প সুদ। এ ছাড়া সেখানকার চামড়া খাত এগিয়ে নিতেও রয়েছে যুগোপযোগী সরকারি নীতি সহায়তা। অথচ আমাদের দেশে এ বিষয়ে সরকারের উদাসীনতায় চামড়া খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
সমাধানও আছে : এ মুহূর্তে চামড়া খাতের ব্যবসা গতিশীল রাখতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণে- এমন মত জানিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, চামড়া খাতে একবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে তা প্রত্যাহার করতে অনেক শর্তপূরণের বেড়াজালে পড়তে হবে। তাই সময় থাকতে সতর্ক হতে হবে।
২০০ একর জায়গায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সাভার শিল্পনগরীতে ১৬ একর জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার। কঠোর নজরদারিতে অতিদ্রুত বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ শেষ করার তাগিদ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হাজারীবাগের ৫০ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে ১৫৬টি ট্যানারি। এসব কারখানায় উৎপাদনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। তাই বর্জ্য শোধনাগারের ন্যূনতম দুটি মডিউল চালু হলেই হাজারীবাগের দূষিত পরিবেশ ছেড়ে সাভার শিল্পনগরীতে পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণ করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে সক্ষম হবেন ব্যবসায়ীরা। ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে না চামড়া খাতে। এ বিষয়ে সরকারকে নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করেন এই বিশেষজ্ঞ। একই সঙ্গে ট্যানারি মালিকদেরও টালবাহানা ছেড়ে কারখানা সরাতে পরামর্শ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ট্যানারি মালিকদের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে নিজেদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কারখানা সরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
গত পাঁচ বছর থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে চলতি বছর তা পেয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। অন্যদিকে চামড়া ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বজায় রাখতে অর্থায়নে স্বল্প সুদে ঋণের আবেদন জানিয়ে এলেও তা এখনো সরকার আমলে আনেনি। দীর্ঘসূত্রতায় না গিয়ে দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, চামড়াশিল্পকে এগিয়ে নিতে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রয়োজন রয়েছে।
চামড়াশিল্পে অদূর ভবিষ্যতে যাতে কাঁচামালের সংকট না হয় সে বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু পালনে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে। তাই সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ারও প্রস্তাব করেন এই বিশেষজ্ঞ। একই সঙ্গে তিনি উৎপাদিত পণ্য বিপণনে সুযোগ সৃষ্টিতে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসম্মত ছোট আকারের দোকান নির্মাণে সরকারকে এগিয়ে আসার সুপারিশ করেন। এতে চামড়া সংকটের আশঙ্কা কমবে।
আবার স্থানীয় এবং রপ্তানিমুখী উভয় ধরনের চামড়াশিল্পের জন্যই আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে। এ ছাড়া শুধু ডেডো সুবিধা নয়, আওতা বাড়িয়ে বন্ড সুবিধা দেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করেন চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা।