মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সেখানকার তেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাবে। এর ফলে তাদের পুনর্বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিমাণ শ্রমিক দরকার হতো সেটা আর হবে না।
Published in Kaler Kantho on Monday, 5 October 2015.
তেলের দাম কমার প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে
শেখ শাফায়াত হোসেন
একদিকে যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যপতন। এই দুই কারণে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। ব্যবসা সম্প্রসারণ, পুনর্বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে রাখছে দেশগুলোর উদ্যোক্তারা। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় অস্থির সরকারগুলোকেও স্বাভাবিক খরচ মেটাতে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তেল রপ্তানি করতে হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আহরণে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এবারের ঈদের আগে পাঠানো রেমিট্যান্স গত বছরের কোরবানির ঈদের আগে আসা রেমিট্যান্স থেকে সামান্য বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার। গত বছর কোরবানির ঈদের ছুটি ছিল ৫, ৬ ও ৭ অক্টোবর। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার। সে হিসাবে এবারের ঈদের আগে মাত্র ২০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৫ কোটি ডলার। আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছিলো ১১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সর্বাধিক রেমিট্যান্স আসা অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। বিদেশি পত্রপত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে এমন আশঙ্কার এক চিত্র পাওয়া গেছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় এক লাখ তেল শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছে এবং কূপ খনন ও উৎপাদন যন্ত্রাপাতি প্রস্তুতকরণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
তেলের দাম কমার প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে
জানা গেছে, এক বছর আগে প্রতি ব্যারেল তেলের দর ছিল ১০০ ডলারের কিছু বেশি। বর্তমানে অপরিশোধিত তেল ৪৫ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। তেলের নিম্নমাত্রার দর দীর্ঘদিন বজায় থাকলে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও রপ্তানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত আগস্টে পাঠানো ১১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার রেমিট্যান্সের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে এসেছে ৬৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে থাকা সৌদি আরব থেকে এসেছে ২৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যা গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত আট মাসের মধ্যে সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল গত মার্চ মাসে। ওই মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩০ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত আগস্টে ২০ কোটি ৯২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। কুয়েত থেকে আট কোটি ২৬ লাখ ডলার, ওমান থেকে ছয় কোটি ৮৪ লাখ ডলার, বাহরাইন থেকে চার কোটি ১০ লাখ ডলার, কাতার থেকে দুই কোটি ৬৮ লাখ ডলার, লেবানন থেকে ৩৩ লাখ ডলার, জর্ডান এবং লিবিয়া থেকে ২৫ লাখ ডলার করে রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের দেশগুলো থেকেও রেমিট্যান্স কমেছে। আগস্টে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। গত আট মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে। ওই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। আর সবচেয়ে বেশি এসেছিল গত জুলাই মাসে, ২৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার। আগস্টে রেমিট্যান্স কমার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আহসান উল্লাহ সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের পরের মাসে সাধারণত রেমিট্যান্স কিছুটা কমে যায়। আগস্টে রেমিট্যান্স কমার সেটা একটা কারণ। তবে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আবার বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। এর মধ্যে ৯০৭ কোটি ২৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে।
জানা গেছে, দেশের বাইরে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। এর মধ্যে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সৌদি আরবে, ২৪ লাখ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি মূলত তেলনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর পড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের আয়-ব্যয়ের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে সেখানকার প্রবাসী শ্রমিকদেরও আয়-ব্যয় কমে যাচ্ছে। কেননা সেখানে বেশির ভাগ শ্রমিকই দৈনিক কাজের পাশাপাশি ওভারটাইম করে। এর থেকে ভালো একটা আয় হয় সেখানকার শ্রমিকদের। ফলে সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় কমে গেলে তাদের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিকদেরও আয় কমে যাবে।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশে নিজস্ব মুদ্রার মান কমিয়ে এনে রেমিটার ও রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করলেও বাংলাদেশে মুদ্রা মান কমানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠানোর আগ্রহও কমে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সেখানকার তেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাবে। এর ফলে তাদের পুনর্বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিমাণ শ্রমিক দরকার হতো সেটা আর হবে না।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরো বলেন, এতে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন যেভাবে বাড়ত, সেভাবে বাড়বে না। যার ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের মোট আয় কমে যাবে।