Published in The Daily Janakantha on Thursday, 22 May 2014.
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলেও শিল্প খাতে বিনিয়োগ নেই
মার্চ শেষে ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ ৯৮ হাজার কোটি
রহিম শেখ
দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলেও শিল্প উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। উচ্চ সুদের কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, মার্চ শেষে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকায়। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নয়, বেসরকারী ব্যাংকগুলোতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ জমে আছে। বিপুল পরিমাণ আমানতের এ অর্থ বিনিয়োগ করতে না পারায় বিপাকে পড়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। যার ফলশ্রুতিতে আমানতের সুদের হার কয়েক দফায় কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে ব্যাংকের এই বিপুল পরিমাণ অলস টাকা শেয়ারবাজার, আবাসন খাতসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হতে পারে।
জানা গেছে, বছর দুয়েক আগে ব্যাংকে নগদ অর্থের হাহাকার ছিল। সে সময় ১৫-১৬ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি অনেক ব্যাংক। টাকার অভাবে ব্যাংকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে অনেকে দ্বারস্থ হয়েছিল উচ্চ সুদের কলমানি মার্কেটে। অথচ এখন এই আমানত ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা অর্থ বিনিয়োগ না করেও আমানতকারীদের নির্ধারিত সুদ দিতে হচ্ছে। যা ব্যাংকের মুনাফায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক ব্যবস্থায় মোট ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা আমানত রয়েছে। আলোচ্য সময়ে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৭৪৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ সময় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গড় আমানত বেড়েছে ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। আর ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সে হিসাবে আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মার্চ শেষে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকায়। ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারিতে ৯৫ হাজার কোটি টাকার ঘরে ছিল এই অলস টাকার পরিমাণ। ২০১৩ সাল শেষে প্রয়োজনীয় তারল্য সংরক্ষণের পর ব্যাংকিং খাতে ৯৫ হাজার ৫৮০ কোটি ৭১ লাখ টাকার তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর কাছে রয়েছে ৪১ হাজার ২০৭ কোটি ২১ লাখ, রাষ্ট্রীয় খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে ১ হাজার ৬১১ কোটি ৯৪ লাখ, বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোতে ৪৩ হাজার ৬৬৩ কোটি ৫৬ লাখ এবং বিদেশী ব্যাংকগুলোতে ৯ হাজার ৯৮ কোটি ১ লাখ টাকার তারল্য রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুমার জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৩ সালে যে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ছিল। এখন পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে, খুব শীঘ্রই ঝুঁকি কেটে যাবে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মার্চ শেষে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় চার শতাংশ। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য (জানুয়ারি-জুন ’১৪) ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ শেষে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মুদ্রানীতির মাত্র অর্ধেক।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে না পারায় ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ অলস অর্থ জমেছে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় ফিরে না এলে শেয়ারবাজার ও আবাসন খাতসহ অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে এই অর্থ চলে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মেয়াদী শিল্পঋণ বিতরণ করেছে ৩০ হাজার ৮৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩২ হাজার ১৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে মেয়াদী শিল্পঋণ বিতরণ কমেছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মেয়াদী শিল্প খাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ সবচেয়ে কম। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫ হাজার ৪৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করলেও চলতি অর্থবছরে হয়েছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের মেয়াদী ঋণ বিতরণ কমেছে ৮১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এসব ব্যাংকে শিল্পঋণ বিতরণ কমেছে ৬৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাই-মার্চ ’১৪ সময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প খাতে ১ লাখ ২২ হাজার ৩৫৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ বেড়েছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার অব্যাহতভাবে কমলেও কমছে না ঋণের গড় সুদহার। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধানও (স্প্রেড) বাড়ছেই। এ পরিস্থিতিতে দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ বাড়ার কথা থাকলেও কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। আর উচ্চ সুদহারের কারণে দেশের ব্যবসায়ীরাও ব্যাংকবিমুখ হয়ে বিদেশী ঋণের দিকেই বেশি ঝুঁকছে।