Published in Alokito Bangladesh on Thursday, 1 May 2014
পদে পদে লঙ্ঘিত শ্রমিক অধিকার
জাহিদুল ইসলাম
২০১৩ সালে দেশে দুর্ঘটনায় কর্মক্ষেত্রে ১ হাজার ৯১২ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৭৩৮ শ্রমিক। এক বছরে ২৫ শ্রমিককে ধর্ষণ করা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে ২১ জনকে। এর বাইরে এক বছরে ৪৯০ শ্রমিককে অপহরণ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৭ শ্রমিক। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন,বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না অনেক শ্রমিক। ঢাকাসহ সারা দেশে ৫০ হাজারের বেশি বস্তির মধ্যে সপরিবারে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন এসব শ্রমিক। তাদের পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে সম্পদশালীরা গড়ে তুলছেন আরও সম্পদের পাহাড়। আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যখন মহান মে দিবস পালিত হচ্ছে, তখন ক্ষতিপূরণ না পেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এক বছর আগে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারের লোকজন। ঘটনার এক বছরেও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ হয়নি। এমনকি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের। যদিও সীমিত পরিসরে ক্ষতিপূরণের ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে।
১২৮ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশের গুলি করার পর বিশ্বের বহু দেশ শ্রমিকদের যেভাবে সম্মান ও অধিকার দিয়েছে, বাংলাদেশ সেভাবে দিতে পারেনি। এখানে কিছু শ্রমিক মে মাসের কড়া রোদে তপ্ত রাজপথে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে সস্নোগান দেয়, হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সেই সস্নোগান।
এখানে মুনাফার বলি হতে হয় শ্রমিকদের। গৃহকর্মীদের দেহ ঝলসানো হয় ফুটন্ত তেলে, বিক্ষত হয় খুনতির ছেঁকায়। হোটেল শ্রমিকরা মরে না খেয়ে, অপুষ্টিতে ভোগে। নির্মাণ শ্রমিকরা প্রাণ হারায় মালিকদের সুউচ্চ অট্টালিকা থেকে পড়ে। কিন্তু আইনের রায় যায় মালিকের পক্ষে, এমনকি বিধান প্রণীতও হয় মালিক শ্রেণীর স্বার্থের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে। বিলসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতের ৭ হাজার ৭১০ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আর এ সময়ে কর্মস্থলে আহত হয়েছেন ১৮ হাজার ৯৩৫ জন। তবে ২০০৭ সালে যারা আহত হয়েছেন, তাদের তথ্য এই হিসাবে নেই।
অনেকেই বলেন, আমাদের মালিকরা মে দিবসে এক দিনের জন্য মুনাফার ছাড় দেন। একই দিনে শ্রমিকদের অল্প পয়সায় কেনার চেষ্টা করেন রাজনীতিবিদরাও। শ্রমিকদের গাড়ি করে জনসভায় নিয়ে আসেন নেতারা। গলা ফাটিয়ে বক্তব্য দেন। রোদে দাঁড়িয়ে সেসব নেতার বক্তব্য শুনতে হয় শ্রমিকদের। সমাবেশে দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেন না নেতারা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। শ্রম আইনে বেসরকারি খাতের শ্রমিকদেরও ছয় মাস মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব এলেও মালিক পক্ষ বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত মালিকদের স্বার্থ রাখতে গিয়ে শ্রম আইনে চার মাস মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেয়া হয়েছে। এক হাজার বা আরও বেশি শ্রমিক রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানে একটি হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখার বাধ্যবাধকতা রাখতে চেয়েছিল সরকার। মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন এর বিরোধিতা করে। আর বিজিএমইএ বলে, প্রতিটি কারখানায় দুই হাজার থেকে চার হাজার শ্রমিক রয়েছে। এ অবস্থায় প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রতিটি কারখানাতেই হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। শ্রম আইনে প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা ছিল। মালিকদের স্বার্থে সরকারগুলো ওই ন্যায্য পাওনা থেকে শ্রমিকদের বরাবরই বঞ্চিত করেছে। লাভের ৫ শতাংশ অর্থ দেয়ার বদলে শ্রমিকপ্রতি বার্ষিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত নির্দিষ্ট অংক ধার্য করার চাপ দিয়েছে মালিক পক্ষ।
দুনিয়ার সব দেশে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের মধ্যে এক ঘণ্টা বিশ্রামের ব্যবস্থা রয়েছে। এ হিসেবে অন্য দেশের শ্রমিকরা ৭ ঘণ্টা কাজ করে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে বিরতির এক ঘণ্টা বাদেই ৮ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকরা কীভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, তার বড় প্রমাণ রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই সাভারের এ ভবনটি ধসে ১ হাজার ১৩৫ শ্রমিক নিহত হন। ঘটনায় আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। তবে ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। তবে এ ঘটনাকে পুঁজি করে মালিক পক্ষ আদায় করে নিয়েছে তাদের অনেক স্বার্থ। সম্প্রতি পোশাক শিল্পের জন্য বিশেষ কর সুবিধা ঘোষণা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিশেষ ভাতা দেয়ার শর্তে পোশাক শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে নেয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। আসছে বাজেটেও বিশেষ শুল্ক সুবিধায় অগি্ননির্বাপণ যন্ত্রসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির সুযোগ পেতে যাচ্ছে খাতটি। সব মিলিয়ে মালিকরা কয়েক হাজার কোটি টাকার সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,এক বছরে পোশাক শিল্পে কয়েকটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে বেশ সুবিধা পেয়েছে মালিক পক্ষ। এখন শ্রমিকদের মজুরি ও কারখানার নিরাপত্তার দিকে নজর দিলে পোশাক খাত লাভবান হবে। শ্রমিক নেতা বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, মালিক পক্ষ পুঁজি বিনিয়োগের আগেই চিন্তা করে কীভাবে শ্রমিকদের শোষণ করা যায়। এ অনৈতিক কাজে সব সরকারকেই কাছে পায় মালিকরা। ঘোষণার পাঁচ মাসেও অনেক পোশাক কারখানায় নূ্যনতম মজুরি বাস্তবায়ন হয়নি। শ্রম আইনে থাকলেও এসব কারখানার মালিককে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।