Published in Bonik Barta on Friday, 5 December 2014.
আমদানি-রফতানি কার্যক্রম
কাগজবিহীন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ব্যয় কমবে এক-তৃতীয়াংশ
বদরুল আলম
ভারতের সঙ্গে রফতানি কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরিতে কনসাইনমেন্টপ্রতি বাংলাদেশের ব্যয় হয় ৩৫০ ডলার। আবার আমদানি কার্যক্রমে এ ব্যয় ৩৯০ ডলার। আর জাপানের সঙ্গে বাণিজ্যে এ ব্যয় ২০০ ডলার। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পাদনে কাগজপত্র তৈরি বাবদ বছরে গড়ে ৬ কোটি ডলার ব্যয় হয় বাংলাদেশের। কাগজে যোগাযোগের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ বাস্তবায়ন করা গেলে এ ব্যয় এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছে জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক কমিশন (এসকাপ)।
এসকাপের হিসাব অনুযায়ী, কাগজের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনায় এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় ব্যয় ৬ কোটি ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা সাড়ে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ব্যয় প্রায় ২৯ শতাংশ কমিয়ে ৪ কোটি ২৬ লাখ ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব। এতে বছরে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
জানা গেছে, আমদানি-রফতানির কাজে ব্যবহূত কাগজে দলিলের মধ্যে রয়েছে— এয়ার ওয়েবিল, বিল অব লেডিং, কমার্শিয়াল ইনভয়েস, হাউস বিল অব লেডিং, হাউস ওয়েবিল, কার্গো ম্যানুফেস্ট, স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট, প্যাকিং লিস্ট, শিপিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রভৃতি। এসব কাগজ ব্যবহারে অতিরিক্ত ব্যয়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত জনবলও প্রয়োজন হয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর। আবার কাগজ প্রস্তুত, জমা করা ও ছাড়ের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতায় সময় লাগে বেশি। ফলে বিলম্বিত হয় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম।
বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক ঋণপত্র দাখিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যেমন ইলেকট্রনিক যোগাযোগের আওতায় আসেনি, তেমনি অনলাইনে কাঁচামালের ঘোষণা-সংক্রান্ত সনদ ইউডি দাখিলের বিষয়টিও কার্যকর করেনি সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। শুল্ক কর্তৃপক্ষের মতে, ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মতো প্রযুক্তিগত বিষয় ছাড়াও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বিলম্ব হওয়ার পেছনে আরো বিষয় জড়িত। যেমন আমদানিকারকের প্রতিনিধি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দলিলপত্র ঠিকমতো না থাকলেও পণ্য ছাড়করণ পিছিয়ে যায়। শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা সময়মতো আইজিএম দাখিল না করলেও বিলম্ব ঘটে। আর বিলম্বিত এ কার্যক্রমে ব্যবহূত কাগজের পেছনে ব্যয়ও বাড়ছে দিন দিন।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ফরেন ট্রেড) মনোজ কুমার রায় বণিক বার্তাকে বলেন, এসকাপসহ আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই পেপারলেস ট্রেডের বিষয়ে কাজ করছে। বাণিজ্য সহজীকরণের অংশ হিসেবে কার্যক্রমগুলোর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সম্পৃক্ততাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারের প্রচেষ্টায় এরই মধ্যে কাগজের ব্যবহার অনেক কমে এসেছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি কাগজের ব্যবহার কমিয়ে আনতে। তবে পুরো বাণিজ্যিক কার্যক্রম পেপারলেস করাটা সময়সাপেক্ষ। পর্যায়ক্রমে ব্যবহার কমিয়েই পুরো প্রক্রিয়াকে পেপারলেস করা সম্ভব।’
এসকাপের হিসাবে, ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পূর্ণ বাস্তবায়নে ব্যয়ের পাশাপাশি আমদানি-রফতানির সময়ও অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে বর্তমানের তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম সময় লাগবে। পুরো এশিয়া অঞ্চলে বার্ষিক ব্যয় সাশ্রয় হবে ৭ বিলিয়ন ডলার।
সংস্থাটির সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশসহ এশিয়া অঞ্চলে পেপারলেস ট্রেড ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অগ্রগতি আছে। তবে প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পেপারলেস ট্রেড বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সমন্বয়ের ঘাটতি হচ্ছে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি দ্রুত বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। আর এ ধীরগতির কিছু বাস্তবতাও রয়েছে। এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের যেমন প্রয়োজন, তেমনি ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা পরিচালনায় দক্ষ মানবসম্পদও দরকার। দুই দিকেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। আবার এটাও ঠিক, একদল মানুষ আছে, যারা আমদানি-রফতানি দলিলাদি প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিত। ফলে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর করতে বেশকিছু প্রস্তুতির বিষয়ও রয়েছে।
দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। এ খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবেশবান্ধব করতে কাগজের ব্যবহার কমিয়ে আনা প্রয়োজন। বাণিজ্য-সংক্রান্ত কাগজ তৈরিতে আমাদের ব্যয় টাকার পরিমাণে খুব বেশি না হলেও এতে সময় ব্যয় হয় প্রচুর, যা কমিয়ে আনা গেলে বাণিজ্যের গতি আরো বেগবান করা সম্ভব। এছাড়া পুরো কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতাও কমতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় আমাদের প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাগজের ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। পোশাক খাতের তরফ থেকে বাণিজ্যিক কাগজ কমিয়ে স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রম প্রতিষ্ঠায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রাতারাতি না হলেও পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে।’