Published in Bhorer Kagoj on Thursday, 4 June 2015.
বিশাল বাজেট পেশ আজ বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়
ওবায়দুর রহমান
প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার ব্যয়বহুল বাজেট পেশ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আজ বিকাল সাড়ে ৩টায় বাংলাদেশের ৪৪তম বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬তম এ বাজেট পেশ করবেন। পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে এ বাজেট উপস্থাপন করা হবে। আর অর্থমন্ত্রী হিসাবে আবুল মাল আবদুল মুহিতের নবম বাজেট। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই প্রথম অর্থমন্ত্রী যিনি ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত একনাগাড়ে ৭টি বাজেট পেশ করছেন। এরআগে তিনি ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে আরো দুটি বাজেট পেশ করেছিলেন।
আসন্ন বাজেট আকারের দিক থেকে যেমন বড়, তেমনি বাস্তবায়নেও রয়েছে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বড় বাজেটের কারণে সাধারণ মানুষের ব্যয়ভার অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষ করে গত দুই বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণে এবার এ খাতে চাপ কিছুটা বেশি থাকবে। রাজস্ব আদায়ের সহজ পন্থাগুলোর প্রতি এনবিআরের নজর বেশি থাকবে। আর সে চাপটা পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) ইতোমধ্যে আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৯৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। এটি চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক কর্মসূচির চেয়ে ২৯.৩৩ ভাগ এবং মূল বাজেটের বার্ষিক কর্মসূচির তুলনায় ২০.৭৭ ভাগ বেশী। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ থেকে ৭.৩ ভাগ নির্ধারনের ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ে বিশাল
লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআরকে)। তা ছাড়া ওই বাজেটে ১০৭টি পণ্য ছাড়া সব পণ্য আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার হচ্ছে, ফলে এ খাত থেকে রাজস্ব আয় কমবে। তাই রাজস্ব আয় বাড়ানোর অন্যান্য কৌশলের সঙ্গে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে সব পণ্যের ওপর ভ্যাট বা মূল্যসংযোজন করের (মূসক) সর্বোচ্চ হার আরোপ করা হবে। বাড়ানো হবে উৎসে করের আওতাও। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব পণ্যে সর্বোচ্চ হারে ভ্যাট আরোপ করা হলে চাপটা পড়বে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। তাদের আশঙ্কা সর্বোচ্চ হারে ভ্যাটা আরোপ হলে অধিকাংশ পণ্যের দাম বাড়বে। তা ছাড়া উৎসে করের জালেও আটকাবে সাধারণ জনগণ। এতে করে অতিমাত্রায় বাড়বে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। তাই বাজেটে সব পণ্যে সর্বোচ্চ করারোপ না করে এর আওতা বাড়ানো এবং বেশি আয়ের মানুষের আয়কর আদায়ে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সম্পদশালী ও দরিদ্র সবাই সমান হারে ভ্যাট পরিশোধে বাধ্য হয়। ভ্যাট রাজস্ব আদায়ের নিশ্চিত হাতিয়ার হওয়ায় এনবিআর এ খাত বেছে নিয়ে থাকে। খুব কৌশলে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর রাজস্বের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশি আয়ের মানুষকে করের আওতায় আনা উচিত। তাই সব কিছু বিবেচনায় আয়কর আদায় বাড়াতে হবে। সরকার মুখে আয়কর আদায়ের কথা বললেও ভ্যাটের বোঝা প্রতি বছরই বাড়াচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, দেশে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা কম। অল্প আয়ের মানুষই বেশি। ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার আরোপ করা হলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। তাই ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাটের দুই স্তরের হার আরোপ করা উচিত। বিলাসজাত পণ্যের ওপর উচ্চ হার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর নিম্ন হার। তাহলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চাপানো হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। গত অর্থবছর পর্যন্ত পরোক্ষ করের ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চলতিবার ছিল ব্যতিক্রম। প্রত্যক্ষ কর ছিল রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত। একই ধারা থাকছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও। আসছে অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে আয়কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। আয়কর খাতে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জনবহুল এ দেশে আয়কর খাতে গুরুত্ব দেয়া উচিত। ১৬ কোটি মানুষ থাকলেও করদাতার সংখ্যা গড়ে ২০ লাখ ছাড়াতে পারেনি, যা দুঃখজনক। এনবিআর যথাযথ কৌশল নির্ধারণ করতে পারলে করদাতার সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে, এতে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। তবে শুধু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেই হবে না, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাস্তবসম্মত কৌশলও থাকতে হবে। গত ও চলতি অর্থবছরে এ বিষয়ে এনবিআর পরিকল্পনা মতো কাজ করতে পারেনি। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এতে সরকারের অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
তবে আয়কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ালেও ভ্যাট বা মূল্যসংযোজন কর (মূসক) আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে পিছিয়ে নেই এনবিআর। জনগণের ওপর রাজস্বের বোঝা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বাড়ছে আরেক ধাপ। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে আয় করের পরেই রাজস্ব আদায়ে স্থানীয় পর্যায়ে মূসক খাতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মূসক আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। আসছে অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে কম লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক খাতে, ৪৬ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব বোর্ড যথাযথভাবে অর্থ সরবরাহ করতে না পারায় চলতিবার সরকার অর্থ সংগ্রহে সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকেছে। এতে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই এ খাতে সুদের হার কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এতে সাধারণ আয়ের মানুষের নিশ্চিত বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। এভাবে বাস্তবতাহীন সিদ্ধান্তে নানাভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজস্ব ঘাটতিতে সরকারের বৈদেশিক ঋণ, বিশেষভাবে দাতা সংস্থার ওপরও নির্ভরশীলতা বাড়ে। আগামী অর্থবছরে এ ধারা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এনবিআরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৬২ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নির্ধারণ করা উচিত।
এনবিআর সূত্র জানায়, রজস্ব আয় বাড়াতে উৎসে কর বা অগ্রিম করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিদ্যমান ৫৮টি ছাড়াও নতুন নতুন খাত চিহ্নিতের কাজ করছে এনবিআর। সূত্রমতে, যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন করমুক্ত আয়সীমার ওপরে, আগামী অর্থবছরে তাদের বেতন থেকে প্রতি মাসে উৎসে কর কর্তনের রীতি চালু হবে। বর্তমানে কর্মকর্তারা বছর শেষে রিটার্ন দাখিলের সময় কর পরিশোধ করে থাকেন। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন থেকে উৎসে কর কর্তনের যে রীতি চালু রয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া নতুন অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য উৎসে করের আওতায় আসতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম মোবাইল ব্যাংকিং। এ ক্ষেত্রে করের হার চূড়ান্ত করার কার্যক্রম চলছে। সব মিলে নতুন করে প্রায় ১৫টি খাত উৎস করের আওতায় আসতে পারে।
অর্থমন্ত্রী পরিস্কার করেছেন যে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস ও বিদ্যুত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, শিক্ষা,স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকেও বাজেটে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। বাজেটে বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে। তবে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হবে। আসন্ন বাজেটে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের মতো চলমান বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হবে।