Published in Shokaler Khobor on Saturday, 29 November 2014.
শুল্কমুক্ত ভারতীয় চাল সরকারি গুদামে
এসএম আলমগীর ও নাজমুল লিখন
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। আমন ধানের ভরা মৌসুমে দেশে উত্পাদিত চালের চেয়েও আমদানি করা চালের দাম কেজিতে দুই-তিন টাকা কম। ফলে কৃষকের কাছ থেকে সরকার ২০ টাকা ৭০ পয়সা কেজি দরে ধান এবং ৩২ টাকা দরে চাল কেনার ঘোষণা দিলেও সে সুবিধাও মিলছে না। কারণ ভারত থেকে আমদানি করা চাল সরকারি গুদামে বিক্রি করছেন আমদানিকারকরা।
এদিকে ভারতের চাল প্রচুর পরিমাণে আসায় উত্তরাঞ্চলের কৃষক, চালকল ও চাতাল মালিকরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। দেশটি থেকে আমদানি করা শুল্কমুক্ত চালের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পেরে নওগাঁ, নাটোর, কুষ্টিয়া এবং বগুড়া এলাকার অধিকাংশ মালিক বন্ধ রেখেছেন তাদের মিল-চাতাল। এতে একদিকে মিলমালিকদের ব্যাংক ঋণের সুদের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে, বেকার হতে বসেছে শত শত চাতাল শ্রমিক।
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ভারত থেকে দেদার শুল্কমুক্ত চাল আমদানির বিষয়টি ইতোমধ্যেই জেনেছেন। এ বিষয়ে সকালের খবরকে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত চাল-গম মজুদ রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানি করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু শুল্কমুক্ত সুবিধা ও ভারতে দাম সস্তা হওয়ায় সীমান্ত এলাকার একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে চাল আমদানি করছে। তবে এভাবে চাল আমদানি রোধে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি। তিনি বলেন, যখন আমাদের দেশে চালের সঙ্কট ছিল তখন বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করে। সে সুবিধা আর বন্ধ করা হয়নি। তবে এখন সময় এসেছে চাল আমদানিতে শুল্ক ধার্য করার। বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে। তিনি দেশে এলেই বিষয়টি নিয়ে আমি তার সঙ্গে বসব এবং চাল আমদানিতে শুল্ক নির্ধারণের অনুরোধ করব। অর্থাত্ সহসাই চাল আমদানির ওপর শুল্ক নির্ধারণ করা হবে।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, যদি প্রমাণ মেলে তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া আমন ক্রয় পরিস্থিতি সচক্ষে দেখতে এবং এসব অভিযোগ যাচাই করার জন্য ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা সফর করব।
আমদানিকারক সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তবর্তী সব স্থলবন্দর দিয়েই এখন প্রতিদিন চাল আমদানি করা হচ্ছে ভারত থেকে। বিশেষ করে যে চালের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, সেই স্বর্ণা চালই আমদানি হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া আতব চালও আমদানি হচ্ছে। বেশি চাল আসছে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। জানা গেছে, প্রতিটন স্বর্ণা চাল আমদানি করা হচ্ছে ৩৭৫ থেকে ৩৮০ মার্কিন ডলারে। আর আতব চাল আমদানি করা হচ্ছে ৩০৫ থেকে ৩১০ মার্কিন ডলারে। অর্থাত্ ৩৮০ ডলারের হিসাবে প্রতিটন চাল আমদানি করলে প্রতিকেজির মূল্য পড়ে ২৯ টাকা থেকে ২৯ টাকা ৬৪ পয়সা (১ ডলার=৭৮ টাকা হিসাবে)। আর ৩০৫ ডলারে আমদানি করা আতব চালের কেজি পড়ছে ২৩ টাকা ৭৯ পয়সা। অথচ বাংলাদেশে খোলাবাজারে প্রতিকেজি স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়। আর আতব চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকায়। অর্থাত্ ভারতের চালের চেয়ে কেজিপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে। এই বাড়তি লাভের আশায় মূলত আমদানিকারকরা চাল আমদানি করছেন বেশি।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সকালের খবরকে বলেন, কৃষক যাতে কোনোভাবে তার কষ্টের ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হয় সে দিকটি সবার আগে নজরে রাখা দরকার। কারণ ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষক ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। দেশে যখন নতুন আমন ধান উঠছে তখন ভারত থেকে চাল আমদানি করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
এদিকে সরকার এবার আমন মৌসুমে ৩২ টাকা কেজি দরে তিন লাখ টন আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরাসরি মিলারদের কাছ থেকে এ চাল সংগ্রহ করা হবে। গত ১৫ নভেম্বর আমন সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের এই চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এ বছর প্রতিকেজি আমন ধান উত্পাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ১৮ টাকা। প্রতিকেজি আমনের বিক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সা। প্রতিকেজি চাল উত্পাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ২৮ টাকা। সরকার এর ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩২ টাকা। গত বছর যা ছিল ৩১ টাকা।
ভারতের আমদানি করা প্রতিকেজি চালের মূল্যের চেয়ে সরকারি ক্রয়মূল্য ২ টাকা ৩৬ পয়সা বেশি হওয়ায় আমদানিকারকরা ভারতের চাল দেদার বিক্রি করছেন সরকারি খাদ্য গুদামে। এ তথ্য জানান খোদ চাল আমদানিকারকরা। হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানি গ্রুপের আহ্বায়ক হারুন-উর রশিদ সকালের খবরকে জানান, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে চালের দাম কম হওয়ায় এবং কোনো আমদানি শুল্ক না থাকায় অধিক লাভের আশায় এখন ভারত থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। কেবল হিলি স্থলবন্দর দিয়েই এখন প্রতিদিন দুই হাজার টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। আর আমদানিকৃত এ চালের সিংহভাগই চালে যাচ্ছে সরকারের সরকারি গুদামে। চাল ব্যবসায়ী বা চাতাল মালিকরা ধান কিনে চাল তৈরি করে তারপর সরকারের কাছে বিক্রি করার চেয়ে ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল বিক্রি করতেই বেশি আগ্রহী। কারণ সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত চাল পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া লাভও বেশি। তিনি বলেন, আমি নিজেও ভারত থেকে চাল আমদানি করছি। কারণ আমরা তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের তো ব্যবসা করতে হবে।
ব্যবসায়ীরা দেশের কৃষকের কথা না ভেবে কেবল তাদের লাভের কথা ভেবে দেদার চাল আমদানি করায় কৃষককে চরম লোকসানে পড়তে হচ্ছে। কারণ ভারতীয় চালের প্রভাবে আমনের নতুন মৌসুমে প্রতিমণ ধানে দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। হিলির কৃষক জয়নুল আবেদীন জানান, এখানকার স্থানীয় বাজারে মাসখানেক আগেও প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে ৮৫০ থেকে ৯৫০ টাকায়। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। অথচ প্রতিমণ ধানের উত্পাদন খরচ পড়েছে ৮০০ টাকার ওপরে। এত কষ্টের ফসল এখন আমাদের লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে।
এদিকে ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির কারণে সমন্বয় করতে না পেরে বগুড়াসহ এই অঞ্চলের অধিকাংশ মালিক বন্ধ রেখেছেন তাদের মিল-চাতাল। এতে একদিকে মিলমালিকদের ব্যাংক ঋণের সুদের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে, বেকার হতে বসেছে শত শত চাতাল শ্রমিক। মিল মালিকরা জানান, আমন সংগ্রহের ভরা মৌসুমে মিল-চাতালগুলো যখন শ্রমিকদের কর্মচঞ্চলে মুখরিত থাকার কথা, তখন বগুড়ার অধিকাংশ মিল-চাতালে সুনসান নীরবতা। শুল্কমুক্ত নিম্ন মানের চাল দেশীয় বস্তায় পাল্টে কম দামে বিক্রি করায় লোকসানের আশঙ্কায় কেউ চালু করছেন না তাদের মিল-চাতাল। ফলে দিনের পর দিন বাড়ছে ব্যাংক সুদের বোঝা। এ অবস্থা চলতে থাকলে পথে বসতে হবে তাদের।
কুষ্টিয়ার চাল ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। চাল বিক্রি একেবারে নেই বললেই চলে। এখনও আমার গোডাউনে অন্তত ৫শ’ বস্তা চাল পড়ে আছে। বিক্রি হচ্ছে না বলে উত্পাদনও বন্ধ রেখেছি। ব্যবসায় এমন দুরবস্থার জন্য ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানিকেই দায়ী করলেন তিনি।
জহুরুল জানান, মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি আমাদের উত্পাদন খরচ ৩৮ টাকা। বিক্রি করি ৪০ টাকা দরে। সেখানে ভারতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকায়। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের চাল নিম্নমানের তারপরও দাম কম এবং চকচকে হওয়ায় মানুষ সেদিকেই ঝুঁকছে বেশি। ভারত থেকে আমদানি করা এসব চাল অধিকাংশ সময় বস্তা পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিভিন্ন নামি কোম্পানির ব্র্যান্ডে নিম্নমানের চাল বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ঈশ্বরদী চাতাল মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক আমিরুল ইসলাম জানান, এখন চাল ব্যবসার উপযুক্ত মৌসুম। আগে এই সময় প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ ট্রাক চাল বিক্রি করলেও এখন সেখানে মাত্র এক থেকে দুই ট্রাক চাল বিক্রি হচ্ছে। এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হল-ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানি করা।
বগুড়ায় প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো মিল-চাতাল রয়েছে। কিন্তু ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির কারণে সমন্বয় করতে না পেরে বগুড়ার অধিকাংশ মালিক বন্ধ রেখেছেন তাদের মিল-চাতাল। জানতে চাইলে জেলার দুপচাঁচিয়া চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোবারক আলী জানান, এখানে প্রায় ৬শ’ চালকল রয়েছে। কিন্তু ভারত থেকে চাল আমদানি হওয়ায় অন্তত অর্ধেক চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বন্ধের উপক্রম। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশরাই ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এভাবে চললে ঋণের টাকা কীভাবে শোধ হবে?
খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে খাদ্যগুদামে চালের মজুদ রয়েছে ১১ লাখ ৪০ হাজার ২৭ টন। গম মজুদ রয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ২৩২ টন। সব মিলিয়ে মজুদ ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৯ টন। গত বছরের তুলনায় এ সময়ে তিন লাখ টন বেশি মজুদ রয়েছে। এত চাল-গম মজুদ থাকার পরও আমদানি যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।