Published in Kaler Kantho on Thursday, 9 July 2015.
ইউরোপের মন্দার ঢেউ বাংলাদেশের রপ্তানিতে
রাজীব আহমেদ ও এম সায়েম টিপু
বড় বাজারগুলোতে রপ্তানির গতি কমে যাওয়ায় দেশের মোট রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বাংলাদেশি পণ্যের বড় তিনটি বাজার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও কানাডায় রপ্তানিতে ভালো করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি গত বছরের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। ইউরোপে প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। কানাডায় রপ্তানি গত বছরের চেয়েও কম হয়েছে। তিন বাজারে ভালো না করায় মোট রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করে আয় করেছে প্রায় ৩১ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশ কম। যদিও আগের বছরের চেয়ে তা ৩.৩৫ শতাংশ বেশি বলে দেখা গেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যানে। তবে প্রবৃদ্ধির এ হার ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। গেল বছরও রপ্তানি আয়ে প্রায় ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইউরোপে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ১৭ শতাংশের বেশি হারে। এ বছর সেখানে রপ্তানি বাড়ার হার কমে ৩.৯০ শতাংশে নেমেছে। ইউরোপ থেকে দেশের রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে। সেখানে গতি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে মোট রপ্তানি আয়ে। অবশ্য গেল বছর যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে কিছুটা ভালো করেছে বাংলাদেশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৯২ শতাংশ। এবার তা বেড়ে ৩.৫৮ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে কানাডায় রপ্তানি কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কানাডায় ১ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ছিল। এবার ওই দেশে রপ্তানি ৬ শতাংশের মতো কমেছে।
অবশ্য বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও দেশীয় অবস্থা বিবেচনায় নিলে রপ্তানি আয়ের গতি হতাশাজনক নয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, বড় বাজারগুলোর অর্থনীতিতে গতি না থাকা ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিই রপ্তানির গতি কমে যাওয়ার জন্য দায়ী। বিশেষ করে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং ক্রেতারা বাংলাদেশ বিমুখ হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাস রাজনৈতিক অস্থিরতায় পোশাক রপ্তানির কার্যাদেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
ইউরোপের মন্দার ঢেউ বাংলাদেশের রপ্তানিতে
ইএবি সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, রানা প্লাজা বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ভাবমূর্তিকে সংকটে ফেলেছে। এর ওপর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কার্যাদেশ কমে গেছে। পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় রপ্তানি আয় এত কম হয়েছে।
বিজিএমএইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থবছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সাড়ে তিন মাসে দেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা কোনো কার্যাদেশই পাননি। এ ছাড়া বিদেশি ক্রেতাজোটের সংগঠনগুলোর কারখানা পুনঃসংস্কারের কারণে ছোট বড় প্রায় ১২০০ কারখানা কোনো কাজ করতে পারেনি। তাই সাম্প্রতিক সময়ের অর্থবছরগুলোর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সবচেয়ে কম রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
সদ্য শুরু হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও রপ্তানি আয়ের খুব বেশি প্রবৃদ্ধির আশা দেখছেন না সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘ইউরো অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বেশি থাকবে এমন আশা করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তুলার দাম কমে যাওয়ায় ডলারের অঙ্কে রপ্তানির পরিমাণে খুব বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করা যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয় এমন তিনটি বাজার হলো ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৭৬.৪৩ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও কানাডা থেকে। ১৮.৫৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র, ৫৪.৬০ শতাংশ ইউরোপের ২৮টি দেশ ও ৩.৩০ শতাংশ কানাডা থেকে এসেছে। বাকি সব দেশ মিলে এসেছে ২৩.৫৭ শতাংশ।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সাম্প্রতিককালে মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতালি, পর্তুগাল সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। দেউলিয়া হয়ে গেছে গ্রিস। এর ফলে পুরো ইউরোজোনের অর্থনীতির গতি কমে গেছে। ফলে ডলারের বিপরীতে ইউরোর দর কমছে। জাপান ও চীনের মতো এশিয়ার বড় বাজারেও বাংলাদেশের রপ্তানির গতি ভালো নয়। চীনে রপ্তানি গত বছরের চেয়ে মাত্র ৫.৩৩ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে জাপানে বেড়েছে মাত্র ৬.৯৮ শতাংশ।
আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতনের কারণে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ রপ্তানি সক্ষমতা হারিয়েছে। ইউরোপের ক্রেতারা মুদ্রার দামের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের পণ্যের দাম কমিয়ে দিচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের সক্ষমতা কমছে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গেল বছর বড় বাজারগুলোতে পণ্যের চাহিদার ঘাটতি দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ওঠানামা করেছে, তবে খুব বেশি ভালো হয়নি। ইউরোপে মন্দাভাব রয়ে গেছে। জাপানও ভালো করতে পারছে না। ইউরোপে বাংলাদেশের অন্যতম বাজার জার্মানি ও স্পেনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। সব মিলিয়ে এ বছরও বেশি রপ্তানির আশা করা যায় না।