Published in Prothom Alo on Wednesday, 18 February 2015.
তৈরি পোশাকশিল্পে সাব-কন্ট্রাক্টিং
২২ মাসেও নীতিমালা হয়নি
শুভংকর কর্মকার
তৈরি পোশাকশিল্পে ঠিকা কাজ বা সাব-কন্ট্রাক্টিং করা কারখানাতেই শ্রমিক নিরাপত্তা ও অধিকারের বিষয়গুলো বেশি উপেক্ষিত থাকে। সে জন্য দুর্ঘটনাও ঘটছে। এসব কারখানার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সরকার একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়ে গত ২২ মাসেও সেটি শেষ করতে পারেনি।
২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১২ পোশাকশ্রমিক মারা যান। আহত হন আরও অনেক শ্রমিক। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরের স্মার্ট গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান আট শ্রমিক। এই দুই কারখানায় নিয়মববহির্ভূতভাবে ঠিকা কাজ হতো—এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। ঘটনা দুটির পর আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত লিখিত চুক্তি অনুযায়ী ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে সাব-কন্ট্রাক্টিং নীতিমালা করার কথা ছিল সরকারের। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাব-কন্ট্রাক্টিং নীতিমালার একটি খসড়া চূড়ান্ত করছে মন্ত্রণালয়। তবে এখনো সেটি নীতিমালা আকারে নির্দেশনা জারি করেনি। সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর এ-সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ের খসড়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে আরও দেরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে গত মাসে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘শুরুতে এ বিষয়ে তোড়জোড় থাকলেও এখন কিছুটা স্লথ হয়ে গেছে। আমরা খসড়া চূড়ান্ত করার আগে অনেকের মতামত নিয়েছি। চূড়ান্ত খসড়াটি একইভাবে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে মতামত নিচ্ছি। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। নীতিমালা হবে।’
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, সংগঠনটির বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৪ হাজার ২২২। আর সক্রিয় কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৫৩২। এর মধ্যে ২ হাজার ৪০০ কারখানা সরাসরি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বাকি ১ হাজার ১৩২ কারখানা অন্যদের কাজ সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ে করে থাকে। অন্যদিকে বিকেএমইএর সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ৯৫৩। অবশ্য এদের অনেকেই আবার বিজিএমইএর সদস্য। তবে দুই সংগঠনের বাইরেও অনেক কারখানা আছে—এমনটাই জানিয়েছেন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা।
জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকা কাজ করা কারখানাগুলো শ্রম আইনের বিধিবিধান মানে না। এসব কারখানার অধিকাংশ কর্মপরিবেশ নিম্নমানের এবং প্রায়ই মজুরি নিয়ে ঝামেলা করে। এ জন্য পোশাকশিল্পে ছোট-বড় শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটে নিয়মিত।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ঠিকা কাজ করা অনেক কারখানাই বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয়। এ কারণে এসব কারখানায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সংগঠন দুটি দায়িত্ব নেয় না। এ ধরনের কারখানাকে নীতিমালার মধ্যে না আনলে এগুলো পোশাকশিল্পের বিষফোড়া হয়েই থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা সরকারকে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে বিজিএমইএর সদস্যদের জন্য একটি নীতিমালা করেছি আমরা। তবে যেসব কারখানা আমাদের সদস্য না, তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে সরকারের নীতিমালাটি অবশ্যই দরকার। তাদের দায়দায়িত্ব আমরা নিতে পারি না।’
তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর ২০১৩ সালের ৩ জুন সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ের নীতিমালা করে বিজিএমইএ। এতে ঠিকা কাজ করা কারখানাগুলোকে বিজিএমইএ অথবা বিকেএমইএর সদস্যপদ নেওয়া ও তা হালনাগাদ রাখতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে গোষ্ঠীবিমা করা, আন্তবন্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পূর্বানুমতি নেওয়াও বাধ্যতামূলক।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকা কাজ করা কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের আইনগত দাবি-দাওয়া সঠিকভাবে পরিপালন করা হয় না। এ ক্ষেত্রে নীতিমালা না থাকায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতার সৃষ্টি হয়।
সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব। আর নিরাপত্তা ঘাটতির জন্য ঠিক কাজ করা কারখানাতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাই বেশি। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে পুরো শিল্পের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে জন্য সব কারখানাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে সরকারকে।
এদিকে সরকারের করা সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ের খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, কমপ্লায়েন্স (উন্নত কর্মপরিবেশ) প্রতিপালনে সক্ষম কারখানাই কেবল ঠিকা কাজ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই কারখানাকে বিজিএমইএ বা বিকেএমইএর সদস্য হতে হবে। ঠিকা কাজের জন্য লিখিত চুক্তিপত্র থাকতে হবে।
খসড়ায় ঠিকা কাজ করা কারখানাকে শ্রমিকদের সরকারঘোষিত ন্যূনতম মজুরি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের ভবনের নকশা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। আর নিয়মের বরখেলাপ করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। সে ক্ষেত্রে অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী, রপ্তানি কাজ সাময়িক ও স্থায়ীভাবে বন্ধও করা হতে পারে।
খসড়ায় আরও আছে, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রতি তিন মাস অন্তর সাব-কন্ট্রাক্টিং করা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের বস্ত্র সেলে পাঠাবে। আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এ বিষয়ে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হবে। নীতিমালাটির নাম হবে ‘তৈরি পোশাকশিল্পে সাব-কন্ট্রাক্টিং নীতিমালা-২০১৪’।
এ বিষয়ে সিপিডির খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খসড়া নীতিমালাটি পরিমার্জন ও সংস্কারের প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ের ক্রয়াদেশ দেওয়া কারখানা মালিক ও বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে দায়দায়িত্বের বিষয়টি নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।