Published in Amader Shomoy on Monday, 27 July 2015.
তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০২১ সালের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কা
রুমানা রাখি
২০২১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবছর চক্রবৃদ্ধিহারে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে হবে ১২ শতাংশ। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিদায়ী অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ শতাংশেরও কম। আর নতুন অর্থবছরে এর চেয়েও কম প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে তৈরি পোশাক শিল্পমালিকরাও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। বিদায়ী অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও অর্জন হয়েছে ৫ শতাংশেরও কম। ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে রপ্তানি সম্ভব হয়েছে মোটে ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এ অবস্থায় আগামী ৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ১৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেই নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এজন্য পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি বাজার সম্প্রসারণ, উচ্চমূল্যের তৈরি পোশাক পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে অন্যান্য খাতের মতো তৈরি পোশাক খাতেও নতুন বিনিয়োগে কাক্সিক্ষত সাড়া মিলছে না।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, কয়েক বছর ধরেই নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে এ খাতকে। তাই পোশাক খাতের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জনে আগামীতে সরকারকে এ খাতের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলেই পোশাক খাত কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে ৬ অর্থবছরের মধ্যে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হলে ১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। আর ১১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হলে ২০২১ সালে রপ্তানি আয় দাঁড়াবে ৪৭ দশমিক ৭০ বিলিয়ন, ১০ শতাংশ হারে হলে ৪৫ দশমিক ১৭ বিলিয়ন, ৭ শতাংশ হারে হলে ৩৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন, ৫ শতাংশ হারে হলে ৩৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন এবং ৩ শতাংশ হারে হলে ৩০ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বিদেশি ক্রেতারা তৈরি পোশাকের দর বাড়িয়ে দিলে এবং বাংলাদেশ কম মূল্যের পোশাকের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি বাড়াতে পারলে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতে পারে। এছাড়া প্রচলিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারের পাশাপাশি এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ দক্ষিণ আফ্রিকা, চিলি, আর্জেন্টিনাসহ অন্য দেশগুলোতেও রপ্তানি বাড়াতে হবে।
এদিকে পোশাক মালিকরা বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের নয়া মেরুকরণের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কমছে। আগে তৈরি পোশাকের মূল জোগানদাতা চিন কমমূল্যের পোশাক রপ্তানি করত না। ফলে সস্তা পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না বিশ্ববাজারে। তাছাড়া চিন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও ভারত উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে দেশগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়নি। এ কারণে এ খাতে বাংলাদেশ বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু আগামীদিনে এ খাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। কারণ হিসেবে তারা জানান, পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বছর তিনেক আগে দেশটিকে বিশেষ বিবেচনায় শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ শ্রীলংকাও একই সুবিধা পেয়েছে সুনামির পর। এদিকে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এটি হলে ভারতও সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে ভিয়েতনামেরও সস্তা পোশাক রপ্তানিতে খ্যাতি রয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা টিপিপি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এটি হলে ভিয়েতনাম কম বা বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করতে ১৬ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মূল বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পাঁচ দেশের রাষ্ট্রদূতদের সমন্বয়ে গঠিত ‘৩+৫’ কমিটির বৈঠকে দেশের পোশাক খাতের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন দিয়েছে নিটঅয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ। তাতে বলা হয়, ম্যাককেনসির ২০১৩ সালের সিপিও জরিপ অনুযায়ী, পরবর্তী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকের মূল উৎসস্থল হিসেবে বিবেচনা করছেন ক্রেতারা। মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ৫টি বিষয় বিবেচনা করে কোন দেশ থেকে পোশাক কিনবে, তা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাকের মূল্য, পোশাকের গুণগত মান, লিড টাইম (পণ্য সরবরাহের সময়সীমা), সক্ষমতা ও ঝুঁকি।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান বিশ্ববাজারে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘাটতি পূরণ করে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা চ্যালেঞ্জ হবে। তিনি বলেন, এজন্য উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি আরও ভালো পণ্য রপ্তানি করতে হবে। কমপ্লায়েন্স লেভেলের উন্নয়ন করতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে সংস্কার হচ্ছেÑ বিদেশিদের কাছে এই ইতিবাচক বার্তা বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পোশাক খাতের জন্য আরও বাজার তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া পোশাক তৈরির কাঁচামালে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনি জটিলতা দূর করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।