Dr Khondaker Golam Moazzem on savings certificate, published in Kaler Kantho on Saturday, 31 January 2015.
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমতে পারে
আবুল কাশেম
শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। আমানতের সুদহারও কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগেরও সুযোগ নেই। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের ভরসা হয়ে উঠছে সঞ্চয়পত্র। ব্যাংক থেকে পাওয়া সুদহারের প্রায় দ্বিগুণ সুদ মিলছে সেখানে। ফলে শেয়ার বিক্রি করে, ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সঞ্চয়পত্র কিনছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে উচ্চসুদে সরকারের ঋণ বাড়ছে দেদার। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বড় আকারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে। দুর্বল রাজস্ব আয়ের সময় উচ্চসুদের এই ঋণ বাজেটে মারাত্মক চাপ সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থায় আর্থিক ও মুদ্রা বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক কমিটি (ক্যাশ অ্যান্ড ডেব্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি বা সিডিএমসি) সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করার কথাও ভাবছে অর্থ বিভাগ।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩.৫০ শতাংশ। আর গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৪০ শতাংশে। আর ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানতের সুদহার ৯.৪০ শতাংশ। ফলে ব্যাংকগুলোতে আমানত রাখার পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪৫.০৪ শতাংশ বা প্রায় দেড় গুণ বেশি। এটি ছয় মাসে নেওয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। বিদ্যমান সুদহার অটুট থাকলে অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমতে পারে
উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের এই বিপুল ঋণে চিন্তিত নীতিনির্ধারকরা। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব আহমেদের সভাপতিত্বে সিডিএমসির এক বৈঠকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত পর্যালোচনা করে সঞ্চয়পত্রের নতুন সুদহার নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।
তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহার এবং সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারের গত পাঁচ বছরের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করে কমিটির সদস্যরা বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার ছিল ১০ শতাংশ। ওই সময় সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১২ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ। ওই সময় পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার ছিল ১২ শতাংশ। ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষ দিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানো হয়। তবে পরে ব্যাংকে তারল্য বাড়ায় ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার কমিয়ে ৯.৫০ শতাংশে নামায়। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমেনি। এই সময়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। ফলে বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যাংকে মেয়াদি আমানত বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সঞ্চয় স্কিমগুলো চালু করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়ামও প্রদান করা হচ্ছে। তবে এখানে যে ফর্মে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম প্রদান করা হচ্ছে তার পরিবর্তে পৃথক একটি ফান্ড গঠন করা যায় কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পারিপাশ্বর্িক বিষয়াদি বিবেচনায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্নির্ধারণের পূর্বে আরো কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করা সমীচীন হবে।’
সিডিএমসির বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি ইনস্ট্রুমেন্ট হলো সবচেয়ে নিরাপদ। এ ধরনের একটি নিরাপদ ইনস্ট্রুমেন্টের সুদের এমন উচ্চ হার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ২০১২ সালের পূর্বে সঞ্চয়পত্রের জন্য নির্ধারিত সুদের হার ফের নির্ধারণ করা যেতে পারে অথবা বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা হ্রাস করা যায় কি না, খতিয়ে দেখা যায়।’
সিডিএমসির সভায় নীতিনির্ধারকরা বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার কারণে সুদবাবদ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। ফলে বাজেটে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে সরকারের নগদ উদ্বৃত্তের পরিমাণও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা) এ আর এম নজমুস ছাকিব বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ঋণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শেষে অতিরিক্ত ১৮ হাজার কোটি টাকা এ খাত থেকে ঋণ পাওয়া যাবে। সঞ্চয় প্রকল্প থেকে নেওয়া ঋণের সুদব্যয় বাজেটের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। আবার সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ বেশি হওয়ার কারণে নগদ উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারকে বাধ্য হয়ে ট্রেজারি বন্ড ও ট্রেজারি বিলের নিলামে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।’
উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র নিয়ে সরকারের ভাবনার বড় কারণ, যে রাজস্ব আয় থেকে এসব ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে, সেখানেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য কম। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ৬০ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। রাজনীতিতে স্বস্তির সময়গুলোতেই যেখানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি, সেখানে চলমান সহিংসতায় তা আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ধারণা, অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি দাঁড়াবে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, উচ্চ সুদে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে। এমন সময়ে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, যখন রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও ভালো নয়। ফলে এসব ঋণের বিপুল পরিমাণ সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে বাজেটের ওপর চাপ বাড়বে।
সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অবরোধ-হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। মূলত কোনো ধরনের ঝুঁকি না থাকায় এবং বেশি লাভের জন্য সবাই এ খাতে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই।
তবে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলে সাধারণ মানুষ, অবসরভোগী চাকরিজীবী, প্রবাসী ও সমাজের বিশেষ জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- এমন আশঙ্কার কথাও সিডিএমসির বৈঠকে বলেছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, সঞ্চয়পত্র দিয়ে সরকার কেবল মানুষকে মুনাফাই দেয় না, বিশেষ জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়। অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট-২) মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ বৈঠকে বলেন, সুদের হার কমানো হলে বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সহায়তার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তখন তাঁদের সঞ্চয় অন্য কোথাও বিনিয়োগ না করে ব্যয় করে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহমুদা আখতার মীনা বলেন, মূলত পেনশনার, ওয়েজ আনার্স, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এখানে বিনিয়োগ করে। তবে সঞ্চয় স্কিমগুলোয় এদের পাশাপাশি কিছু বড় আকারের বিনিয়োগকারীসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও হয়ে থাকে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরল হারে নির্ধারিত হয়। কিন্তু ব্যাংকের সুদহার চক্রাকারে নির্ধারিত হয়। তাই সঞ্চয়পত্রের সুদহার পুনর্নির্ধারণের সময় সব দিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।