Published in Naya Diganta on Saturday 5 September 2015.
সীমান্তে গরু নাটক কৃষকের মাতম
জিয়াউল হক মিজান
ধর্মীয় কারণে গরু রফতানি নিষিদ্ধ করেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। অথচ সে দেশ থেকে ৩৩টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার গরু প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। গরু আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারেরও কোনো ঘোষণা নেই। অথচ চোরাকারবারিদের আনা গরুকে ‘ভবঘুরে’ ঘোষণা দিয়ে সরকারি স্লিপেই চালান কাটছে সীমান্তরক্ষি বাহিনী। আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে গরু নিয়ে এমন নাটক বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে দেশের লাখ লাখ গরু লালন পালনকারী কৃষকের মধ্যে। বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ সারা দেশের কৃষকের ঘরে ঘরে মাতম শুরু হয়ে গেছে। ভালোভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে এবারের কোরবানিতে গরু নিয়ে মহাকেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষক, কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গোশত ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্বেও বাংলাদেশ গরুর গোশত ও দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারছে না। এর প্রধান কারণ ভারত সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে গরুর অনুপ্রবেশ। ভারত থেকে প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করে জানিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, উপযুক্ত দাম না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেক কৃষক গরু মোটাতাজাকরণের কাজটি করেন না। যারা অনেক কষ্টে, নিজেরা খেয়ে না খেয়ে কোরবানীর সময় বাড়তি লাভের আশায় গরু মোটাতাজা করেন অধিকাংশ বছরই তারা কাঙ্ক্তি দাম না পেয়ে হতাশ হন। কিন্তু সরকার যদি কঠোর ভাষায় ঘোষণা দেয়, ভারত থেকে কোনোক্রমেই গরু প্রবেশ করতে দেয়া হবে না, তবে কোরবইনদাতাদেরকে গরু দু-এক বছর একটু বাড়তি দাম পরিশোধে কোরবানি করতে হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবেন ভোক্তারাই। আর দেশে যদি সম্ভাবনা অনুযায়ী গরু লালনপালন হয় তবে সরকার নানাভাবে লাভবান হবে। অনেক ক্ষেত্রেই স্বাবলম্বি হবে দেশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাগজে-কলমে গরু আমদানি-রফতানির কোনো বিধান না থাকায় সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে রীতিমতো ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভারতের বিভিন্ন হাট থেকে সস্তায় কেনা গরু ভারতীয় মহাজন বা গরু ব্যবসায়ীরা সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামের বিভিন্ন অংশে জড়ো করে বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ী বা মহাজনদের খবর দেন। বাংলাদেশের মহাজনরা লোক পাঠিয়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্তের ওপার থেকে গরু নিয়ে আসেন। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষিরা এ ক্ষেত্রে ‘দেখেও না দেখার ভান করেন’। সীমান্তের ওপার থেকে আসা গরুগুলোকে বাথানে জড়ো করা হয়। স্থানীয়ভাবে একে ‘খাটাল’ বা ‘বিট’ বলা হয়। এর পর শুল্ক কর্মকর্তারা প্রথা অনুসারে খাটালের গরুগুলোকে প্রথমে মালিকানাবিহীন অবস্থায় দেখিয়ে ‘বাজেয়াপ্ত’ ঘোষণা করেন। বাজেয়াপ্ত করার জন্য কাগজে-কলমে সংপ্তি বিচার আদালতও বসে। আদালতের রায়ে ‘মালিকবিহীন বাজেয়াপ্ত’ একেকটি গরু মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ীর কাছে ফের বিক্রি করে দেয়া হয়। বাস্তবে চোরকারবারিদের কাছ থেকেই ব্যবসায়ীরা গরু কেনেন। সরকারকে ৫০০ টাকা দেয়ার বিনিময়ে চার দিন মেয়াদি গরুর মালিকানার রসিদ পান তারা। রসিদের নম্বরটি গরুর গায়ে রঙ দিয়ে লিখে দেয়া হয়। এভাবেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে ভারতীয় গরু।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন গরু ও মহিষের সংখ্যা দুই কোটি ৮০ লাখ। গত ৬ মাসে গরু পালন করে লাভবান হওয়ায় কৃষক ও বেকার যুবকরা আবারো গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণে মনোযোগী হয়েছে। গরু পালনকারী সত্যিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সঠিক প্রণোদনা পেলে আগামী ৫ বছরে গরু মহিষের সংখ্যা ৮ কোটিতে উন্নীত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে এ শিল্পে লাখ লাখ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। দেশের গোশত ও দুধের ঘাটতি মিটে যাবে। দুধ আমদানি করা লাগবে না। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। দেশে বাড়বে জৈবসারের পরিমাণ। সার আমদানিও কমে যাবে। গোবর থেকে জৈব গ্যাস উৎপাদন করা যাবে। এ গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে পারিবারিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তখন আর গোশতের জন্য ভারতের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। গরু আনতে গিয়ে সীমান্তে প্রতিদিন নিরীহ রাখাল গরু ব্যবসায়ীরা বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাবে না। যদিও ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ না হওয়ায় সম্ভাবনার প্রায় সব টুকুই রয়ে যাচ্ছে অপূর্ণ। বছর বছর গরু লালন-পালন করে উপযুক্ত দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন অনেকে কৃষক।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভারত থেকে গরু আমদানির ক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকারই বেশ আগ্রহী। কারণ ভারতে যত গরু উৎপাদন হয় তত ভোক্তা নেই। আর বাংলাদেশে যত ভোক্তা আছে তত গরু উৎপাদন হয় না। যদিও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর পাল্টে যায় ভারত সরকারের মনোভাব। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গত মার্চে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা সফর করে ধর্মীয় মনোভাব থেকেই গরু চোরাচালান বন্ধে নজরদারি কঠোর করার নির্দেশ দেন। এ কারণে সীমান্ত পথে গরু আমদানি কমে গেলে আশায় বুক বাঁধতে থাকেন দেশের লাখ লাখ গরুচাষি। লাভের আশায় নিজেরা খেয়ে না খেয়ে গরুর পেছনে খরচ করতে থাকেন বাড়তি অর্থ। কিন্তু কুরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সীমান্ত উন্মুক্ত হতে থাকায় আবার হতাশার সাগরে ডুবতে থাকেন কৃষকেরা। তাদের আশঙ্কা, ভারত থেকে অধিক হারে গরু এলে কুরবানিতে নিজেদের গরুর উপযুক্ত দাম পাবেন না তারা।
এ দিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করলে দেশটির বহুল প্রচারিত পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়ে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হলে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ গরুর স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গোশালায় রাখতে হবে। এতে বছরে যে ব্যয় হবে, তা শিশুদের পুষ্টি নিরাপত্তায় ভারত সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ অর্থের প্রায় চার গুণ। ভারতে গরুর গড় আয়ু ১৫-২০ বছর। সাধারণত মৃত্যুর পাঁচ বছর আগেই একটি গাভী দুধ দেয়া বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের একটি গরু গোশালায় রেখে খাওয়ানো ও রণাবেণ এবং এ কাজে নিয়োজিত কর্মীর বেতন বাবদ খরচ হয় বছরে ২৫ হাজার রুপি। সে হিসাবে ১ কোটি ২৫ লাখ গরুর পেছনে বছরে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে ৩১ হাজার ২৫০ কোটি রুপি। গরু রফতানিতে ভারতীয় পক্ষের বিভিন্ন অংশের এমন উদ্বেগ হতাশা বাড়াচ্ছে বাংলাদেশের কৃষক মনে। তাদের দাবি, ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ করে দেয়া হলে প্রথম দিকে কয়েক বছর ক্রেতাদের কিছুটা অসুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবে দেশ এবং দেশের অর্থনীতি।