আপাতত সমস্যা না হলেও বাংলাদেশের উৎপাদনসক্ষমতা বাড়ানো দরকার। কারণ ভবিষ্যতে ভারতসহ অন্য প্রতিযোগীরা যদি টিপিপিতে যুক্ত হয়, তখন বাংলাদেশ বিপদে পড়বে।
Published in Prothom Alo on Wednesday, 7 October 2015.
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাণিজ্যে টিপিপির প্রভাব
আপাতত শঙ্কা কম, দুশ্চিন্তা ভবিষ্যতের
শুভংকর কর্মকার
টিপিপিভুক্ত ১১ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যটিপিপিভুক্ত ১১ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও মেক্সিকো। ভিয়েতনামসহ ১১টি দেশ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি করেছে। এর ফলে টিপিপিভুক্ত ১২ দেশ পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
তাৎক্ষণিকভাবে পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা ছিল, এর জন্য বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তবে এক দিন পরে ব্যবসায়ীদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টিপিপি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য আপাতত হুমকির মুখে পড়বে না। এখন এই পণ্যটির রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে চুক্তিটির শুল্ক ও অশুল্ক নানা নিয়মনীতির কারণে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ কিছুটা জটিলতার মধ্যে পড়তে পারে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর একাধিক নেতা, পোশাক খাত নিয়ে কাজ করেন এমন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশটিতে ৪৮৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ৯২৬ কোটি ডলারের পোশাক। আর সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে চীন। গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভিয়েতনাম দ্বিতীয় এবং বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আছে যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেক্সিকো টিপিপি স্বাক্ষর করলেও তারা নাফটা চুক্তির অধীনে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। তাই আপাতদৃষ্টিতে ভিয়েতনামকে কেবল বাংলাদেশের জন্য হুমকি মনে হচ্ছে। কারণ তারা এখন শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু এটি পেতে হলে পোশাকের কাঁচামাল (তুলা, সুতা বা কাপড়) পিপিপিভুক্ত দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। আর বর্তমানে ভিয়েতনাম পোশাকের কাঁচামালের একটি বড় অংশই তাদের সীমান্তঘেঁষা চীন থেকেই আনে।
বাংলাদেশ পোশাকের যে শীর্ষ ৫০টি ধরন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, তার মধ্যে ৩২টি ভিয়েতনামও রপ্তানি করে। এগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে রপ্তানি করে ভিয়েতনাম। এমন তথ্য দিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার মোয়াজ্জেম বলেন, টিপিপির কারণে ভিয়েতনাম এখন শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। সে জন্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সুবিধাটি নিতে হলে তুলা, সুতা বা কাপড়ের জন্য ভিয়েতনামকে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই যেতে হবে। কারণ টিপিপির অন্য দেশগুলোতে এগুলো পাওয়া যাবে না। আর এ জন্য খরচ ও সময়ের বিচারে কতটা ভিয়েতনামের পক্ষে যাবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
টিপিপি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই দারুস সালাম, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, পেরু ও সিঙ্গাপুর। এর মধ্যে গত বছর অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, পেরু ও সিঙ্গাপুর মিলে ১২৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। মেক্সিকো করেছে ৩৭৩ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডাসহ টিপিপির অন্য দেশে পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে ভিয়েতনামের। তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কেউ এমন কথা বললেও গতকাল বিজিএমইএ জানায়, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়া, চিলি ও নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ আগে থেকেই শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। ফলে এ ক্ষেত্রেও সমস্যা হবে না।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, টিপিপির কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে যে গতিতে প্রবৃদ্ধি হবে, সেটি হয়তো থমকে যাবে। কারণ টিপিপিতে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখন বাড়তি সুবিধা পাবে। তিনি বলেন, ‘এ জন্য চীন বেশি সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশের জন্যও এটা হুমকির মতো।’
অন্যদিকে বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘রাতারাতি আমাদের রপ্তানি কমবে না। তবে টিপিপি আমাদের জন্য হুমকি হবে না এমনটা ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’ তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনামের পোশাকশিল্পে অনেক চীনা বিনিয়োগ আছে। চীনা খুব দ্রুত কারখানা তৈরি করে উৎপাদনে যেতে সিদ্ধহস্ত। তাই টিপিপির কারণে অনেক চীনা বিনিয়োগ ভিয়েতনামে চলে যেতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ঝামেলায় পড়তে পারে।’
এদিকে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আপাতত সমস্যা না হলেও বাংলাদেশের উৎপাদনসক্ষমতা বাড়ানো দরকার। কারণ ভবিষ্যতে ভারতসহ অন্য প্রতিযোগীরা যদি টিপিপিতে যুক্ত হয়, তখন বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। তাই আগামী টিকফা বৈঠকে এই চুক্তির ফলে অন্য দেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা অনুমোদনের জন্য আলোচনা করা উচিত।’