বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরাও ভিয়েতনামে পোশাক খাতে বিপুল বিনিয়োগ করবেন, যা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
Published in Jugantor on Friday, 9 October 2015.
চ্যালেঞ্জের মুখে পোশাক খাত
শাহ আলম খান
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১২ দেশের নতুন অর্থনৈতিক জোট ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে এই জোটে ভিয়েতনামকে অন্তর্ভুক্ত করায় তৈরি পোশাক রফতানিতে এ মুহূর্তে অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি বাংলাদেশ। কারণ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বিনা শুল্কে পণ্য রফতানির সুযোগ পাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে লাভবান হবে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক বাজারে প্রতিযোগী দুই দেশ- বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের রফতানি বাণিজ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টিপিপি চুক্তির কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ টাকায় প্রায় ১৬ টাকার সক্ষমতা হারাবে। অর্থাৎ বিনা শুল্কে রফতানির সুযোগ মেলায় ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যে পণ্য ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবে, ওই পণ্য বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে ১১৬ টাকায় বিক্রি করতে হবে। ফলে ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এ রফতানিকারক দেশে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বছরে ৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকার আর্থিক সক্ষমতা হারাবে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সার্বিক রফতানির পরিমাণই হচ্ছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা ধরে)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টিপিপি চুক্তি নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই অনেক বিতর্ক ও আপত্তি ওঠে। এরপরও শেষ পর্যন্ত সোমবার দেশটির আটলান্টা প্রদেশে যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্র“নাই, কানাডা, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সূত্র মতে, এসব দেশ যৌথভাবে বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
দেশে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান টিপিপি চুক্তি প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, টিপিপিতে ভিয়েতনাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য বড় ধরনের থ্রেড (হুমকি)। এর ফলে রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানোর আশংকা দেখা দেবে। তিনি এর উদাহরণ টেনে বলেন, বর্তমানে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই আমাদের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক রফতানি বাজার। এ বাজারে আমরা প্রতি বছর গড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি করি। কিন্তু একই সময়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করছে। এতে বাংলাদেশ যে পণ্য রফতানি করে, সেখানে প্রায় ১৬ শতাংশ গড় শুল্ক দিচ্ছে। চুক্তির আগেই ভিয়েতনাম মাত্র ৮ শতাংশ গড় শুল্ক দিত। অর্থাৎ ৮ শতাংশ বাড়তি সুবিধা নিয়েই তারা আমাদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রফতানি করত। ফলে দেশটির মার্কেট শেয়ার বাংলাদেশের তুলনায় এমনিতেই ভিয়েতনামের বেশি। এ পরিস্থিতিতে এখন বিনা শুল্কে রফতানির সুযোগ পেয়ে তাদের রফতানি কত বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে কিংবা মার্কেট শেয়ারের কতটা বাড়তি দখল করবে সেটিই এখন আশংকার অন্যতম কারণ।
এদিকে ভিয়েতনামে অবস্থিত আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের (অ্যামচেম ভিয়েতনাম) এক রোডম্যাপে টিপিপি চুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরে আমেরিকান বাজারে ভিয়েতনামের পণ্য রফতানি বিষয়ে উচ্চাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। বাণিজ্যিক এই সংগঠনের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ক পোস্ট করা ওই রোডম্যাপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি বর্তমানের ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ২০ বিলিয়ন (১৯ দশমিক ৯) ডলার অতিক্রম করবে। অর্থাৎ এই সময়ে প্রতিযোগী এই দেশটির রফতানি দ্বিগুণেরও বেশি উন্নীত হবে। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ বর্তমানের ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে থাকার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। একই কারণে চীনের রফতানির পরিমাণও কমবে। বর্তমানের চীন ৪০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করছে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই সময়ে এর পরিমাণ কমে ৩৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসার আভাস দেয়া হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউ সেল সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের পণ্য রফতানিতে গড় শুল্ক হার ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর আরোপিত গড় শুল্ক হার ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এখন ভিয়েতনাম টিপিপিভুক্ত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সব দেশেই বিনা শুল্কে পণ্য রফতানি করবে। তবে সেখানে বাংলাদেশকে আগের মতোই প্রায় ১৬ শতাংশ গড় শুল্ক দিতে হবে।
মার্কিন বাণিজ্য দফতর ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে টিপিপি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর ২০১১ সালে চুক্তিকারী দেশের প্রতিনিধিরা প্রথম বৈঠকে মিলিত হন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে ওই চুক্তি পরিণতি লাভ করে।
দীর্ঘ সময় পেয়েও কেন বাংলাদেশ টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেনি জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যেসব শর্ত ছিল, তাই জানতে পারেনি বাংলাদেশ। কারণ চুক্তির শর্ত প্রকাশই করা হয়নি। টিপিপির কাজ হয়েছে খুব গোপনে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আগ্রহী হলেও যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্যান্য সহযোগী দেশের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও অন্যতম পোশাক শিল্পোদ্যোক্তা একে আজাদ যুগান্তরকে বলেন, টিপিপি চুক্তিতে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভিয়েতনাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন চরম ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে উদ্যোক্তাদের। এ চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যাবে যদি অদূর ভবিষ্যতে সেখানে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়। কারণ সেখানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ অসম প্রতিযোগিতা থেকে উত্তরণে সক্ষমতা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সমঝোতা ছাড়া বিকল্প নেই। সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২০০১ সালে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পণ্য ও সেবা বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে জোর দেয়ার পরামর্শ দেন। তাহলে টিপিপি সত্ত্বেও ভিয়েতনাম বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ থাকবে। কারণ তখন ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার শূন্য হলেও বাংলাদেশী পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক হার এখনকার প্রায় ১৬ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশে নেমে আসবে। ভিয়েতনামে যেহেতু শ্রমের মজুরি বেশি, তাই ৫ শতাংশ শুল্ক দিয়েও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এর বাইরে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে ওভেন ও নিট পোশাক তৈরির জন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে সুতা আমদানি করি তার শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা।
তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, টিপিপি নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন নয়। কারণ ওই চুক্তির আওতায় শুধু ভিয়েতনামই বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এর থেকে দেশটি যে সুবিধা পাবে, বাংলাদেশ ওই সুবিধা অন্য দেশের কাছ থেকে পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে। এর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এসব চুক্তির আওতায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বেশি করে পণ্য রফতানি এবং শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, চুক্তির নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আমরা জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি পোশাক রফতানিতে আরোপিত উচ্চ হারের শুল্ক হ্রাস ও এর কাঁচামাল সুতা আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, এ চুক্তির ফলে ভিয়েতনামের পণ্যমূল্য হ্রাস পাবে। ফলে কম দামে তাদের পোশাকের প্রতি ক্রেতার চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা হারাবে। আবার বাজারও সংকুচিত হয়ে পড়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কারণ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ভিয়েতনামে ভিড় করছেন। আগে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিতেন, এমন অনেক ক্রেতাও এখন যাচ্ছেন ভিয়েতনামে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যুগান্তরকে বলেন, টিপিপি চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম বিনা শুল্কে পণ্য রফতানির সুযোগ পাবে। ফলে অনেক ক্রেতাই মূল্য বিবেচনায় এনে তারা ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকবেন, বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরাও ভিয়েতনামে পোশাক খাতে বিপুল বিনিয়োগ করবেন, যা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।