Published in Bonik Barta on Saturday, 17 January 2015.
৬ মাস ধরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে ওভেন
বদরুল আলম
দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। আর এতে অর্ধেকের বেশি অবদান ওভেন পণ্যের। তিন অর্থবছর ধরে পোশাক রফতানিতে চলে আসছে ওভেনের আধিপত্য। তবে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ছয় মাস ধরে পণ্যটির রফতানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারক দুই সহস্রাধিক কারখানার মালিক।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর জাতীয় রফতানিতে ওভেন পণ্যের অবদান ছিল ৪১ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৯ দশমিক ৯৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশে বাংলাদেশে তৈরি ওভেন পণ্যের রফতানি কমছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে এ পণ্য থেকে আয়ও। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে দেশের ওভেন পোশাক প্রস্তুতকারক কারখানাগুলোর ক্রয়াদেশ কমছে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ইউরোপের বাজারে ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো বাণিজ্য সুবিধা পেতে শুরু করায় তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের ওভেন প্রস্তুতকারকরা। ফলে রফতানি আয়ে ধারাবাহিক ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে রফতানিতে চিরকালের জন্য আধিপত্য হারাতে পারে ওভেন খাত।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই পোশাকের মোট রফতানিতে ওভেন পণ্য পিছিয়ে ছিল। জুলাইয়ে ওভেন পণ্য থেকে আয় ছিল ১২১ কোটি ডলার। সে সময়ে নিট পণ্যের রফতানি আয় ছিল ১৩০ কোটি ডলার। এতে নিট পণ্যের আয়ে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয় ওভেন পণ্যে। এর পর প্রতি মাসেই নিট পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক থাকলেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি ওভেন রফতানিকারকরা। সর্বশেষ জুলাই থেকে ডিসেম্বরে নিট পণ্যের রফতানি আয়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও দশমিক ৩৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয় ওভেনে। অর্থবছরের ওই সময় পর্যন্ত নিট পণ্য রফতানি করে ৬০৬ কোটি ডলার আয় হলেও ওভেন পণ্য রফতানি আয় হয়েছে ৫৯৬ কোটি ডলার।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারগুলোয় তৈরি পোশাকের চাহিদায় ঘাটতি ছিল। এর পেছনে দেশগুলোর নিজস্ব অর্থনৈতিক মন্দা যেমন দায়ী, তেমনি দায় রয়েছে আমাদের কমপ্লায়েন্স অব্যবস্থাপনারও। এক্ষেত্রে মূল প্রভাব পড়েছে দেশের ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারক কারখানাগুলোর ওপর। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সব মিলিয়েই ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারকরা তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। নিট প্রস্তুতকারকরাও উদ্বিগ্ন, তবে আতঙ্ক ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারকদেরই বেশি।
জানা গেছে, বিজিএমইএর হালনাগাদ নিবন্ধিত সদস্য কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ২০০। এর মধ্যে সক্রিয় রয়েছে ৩ হাজার ৬০০, যার ৬০ শতাংশই ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারক কারখানা। এ হিসাবেই ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারক কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ১৬০টি।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) জার্মানিতে পুরুষদের ব্যবহার উপযোগী বাংলাদেশে তৈরি স্যুট, জ্যাকেট, ট্রাউজার ও শর্টস রফতানি হয়েছে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ডলার। এ হিসাবেই জার্মানিতে স্যুট, জ্যাকেট, ট্রাউজার ও শর্টস রফতানি থেকে আয় কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। একইভাবে আয় কমেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে এত দিন বাণিজ্য সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। এখন বাংলাদেশের পাশাপাশি আরো কিছু দেশ এ সুবিধা পেতে শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশের ওভেন কারখানা মালিকরা এখন কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে ওভেন প্রস্তুতকারকদের মধ্যে। যদিও গত তিন অর্থবছরে ওভেন খাত অনেক এগিয়েছিল।
২০১০-১১ থেকে সর্বশেষ ২০১৩-১৪ পর্যন্ত টানা তিন অর্থবছর পোশাক খাতের রফতানি আয়ে আধিপত্য ছিল ওভেন পণ্যের। তবে চলতি (২০১৪-১৫) অর্থবছরের শুরু থেকেই রফতানি আয়ে নিটের তুলনায় ওভেন পণ্য পিছিয়ে পড়ে। এর পর ছয় মাস কেটে গেলেও ওভেন পণ্য প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত তিন অর্থবছরে নিট পণ্যের তুলনায় ওভেন পণ্য এগিয়ে যাওয়ার কারণ ছিল ইইউতে বাণিজ্য সুবিধা হিসেবে শিথিল হওয়া ‘রুলস অব অরিজিন’। ফলে ওই অঞ্চলের আমদানিকারকরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় ওভেন পণ্য কিনতে পারছিলেন এবং বাংলাদেশ থেকে ওভেন পণ্যের রফতানি ক্রমেই বেড়ে চলছিল।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ইইউর রুলস অব অরিজিনে পরিবর্তন আসে।
এতে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ওভেন খাতের আধিপত্য বাড়তে শুরু করে। ওই অর্থবছর নিট পণ্যের রফতানি আয় ছিল ৯৪৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং ওভেন পণ্য রফতানি থেকে আয় হয় ৯৬০ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ— দুই ধরনের প্রভাবেই ওভেন পণ্যে আধিপত্য কমতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো বড় বাজারগুলোর চাহিদা ঘাটতি যেমন এর কারণ, তেমনি ইইউর বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়াও এজন্য দায়ী। এছাড়া বড় ক্রেতারা শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না। আর ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারকরাই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে ছিলেন বেশি। সব মিলিয়েই ওভেনের তুলনায় নিট পণ্য প্রস্তুতকারকদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী এখন।