Published in Kaler Kantho on Tuesday, 17 February 2015.
সহিংসতা গিলে খাচ্ছে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট
আবুল কাশেম ও আরিফুর রহমান
২০১০ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল শান্ত। ওই বছর থেকে অর্থনীতিতে কমতে শুরু করেছিল বিশ্বমন্দার প্রভাবও। পরের বছরগুলোতে রাজনীতি স্থিতিশীল থাকবে, বিশ্বমন্দা কেটে যাবে- এমন আশায় দশ বছর মেয়াদি (২০১১-২১) ‘রূপকল্প ২০২১’ ও পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১১-১৫) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। এরপর বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে দিন দিন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচালের লক্ষ্যে শুরু হওয়া সহিংসতা এখন রাজনৈতিক কর্মসূচির নামেও চলছে। এ অবস্থায় গত পাঁচ অর্থবছরে ওই লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগামী পাঁচ বছরেও যে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছা সম্ভব নয়, তা মেনে নিচ্ছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাই ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে আশা সরকার করেছিল, সেখান থেকে বহু পেছনে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রণয়ন করা হচ্ছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা।
রূপকল্প ২০২১ ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সূত্রে জানা গেছে, আগামী জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণেই কেবল কাটছাঁট নয়, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছে। কর্মসংস্থান, জাতীয় সঞ্চয়, বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), আমদানি-রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে পাঁচসালা পরিকল্পনা। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরে বাংলানগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়। সে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সভায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানসহ কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি; বরং সেখানে দেশের বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে যদি আবার দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এক কোটি ৩২ লাখ মানুষকে চাকরি দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়েছে। অথচ চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এখানে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রায় কাটছাঁট করা হয়েছে। চাহিদার আলোকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে না- সেটি আগেই মেনে নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬.৮ শতাংশ, পরের অর্থবছর ৭.২ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭.৬ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়েছে। অথচ সরকারের দশ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮.৩ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮.৭ শতাংশ, পরের অর্থবছর ৯.১ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯.৪ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯.৭ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে দেখা গেছে, সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোনো সামঞ্জস্য নেই। যদিও তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেছিলেন, প্রেক্ষিত পরিকল্পনার আলোকেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু সরকার সেটি করতে পারেনি। এ ছাড়া চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ, আগের বছর ৭.২ শতাংশ এবং এরও আগের বছর ৭ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো বছরই কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ব বাস্তবতা মাথায় রেখে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিল প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেখানে প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা করা হয়নি। চলমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে দলিল প্রণয়ন করা হয়েছে। সে জন্য আগের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এবার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। শামসুল আলম বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে থাকা অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক অর্জিত হয়নি, বিষয়টি সত্য। তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো অর্জিত হবে। এটি বাস্তবায়নযোগ্য হবে। এ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে গেলে এই পরিকল্পনা দলিল মধ্যবর্তী সংশোধন করা হবে। অর্থনীতি যদি উজ্জীবিত ও প্রাণময়তা ফিরে পায় তাহলে তা সংশোধন করে নতুন করে সূচক নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি।
জিইডির তথ্য মতে, আসছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় জিডিপির ১২ শতাংশ, পরের বছর ১২.৪ শতাংশ, পরের বছর ১২.৫ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২.৮ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়েছে। অথচ চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রাজস্ব আহরণে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে রাজস্ব আদায় জিডিপির ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর শেষে দেখা গেছে, গত বছর রাজস্ব আদায় হয়েছে জিডিপির মাত্র ১১ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা বলছেন, রূপকল্প ২০২১ ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ছিল উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব। দেরিতে হলেও সরকার তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। আর সে উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো অর্জন করতে হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়সহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সেগুলো ছিল উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব। তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বাস্তবতা আমলে নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে তা হবে ভালো সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। কারণ ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ জিডিপির ৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু সেটি গত কয়েক বছর ধরে ২৮ শতাংশে অবস্থান করছে। বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মানুষকে অবাস্তব স্বপ্ন দেখানো ঠিক নয়। আর চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে তাও অর্জিত হবে না বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সেগুলো ছিল অযৌক্তিক। দেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটি করা হয়নি। আমাদের ধীরে ধীরে এগোতে হবে। আগে ৭ শতাংশ, পরে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। আমরা এখনো ৭ শতাংশেই যেতে পারিনি। অথচ ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখছি।’ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে মনে করেন তিনি। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে।