Published in Daily Bartoman on Monday, 25 August 2014.
মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার
পাঁচ বছরেই মধ্যম আয়ে
রেজাউর রহিম
মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য অর্জনে কাজ শুরু করেছে সরকার। আর সেজন্য গ্রহণ করা হচ্ছে এক মহাপরিকল্পনা। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের কর্মক্ষম সব বেকার ও সাময়িক বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি এ মহাপরিকল্পনায় সরকারের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হচ্ছে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ উন্নত দেশে উন্নীত করা।
সূত্র জানায়, মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের মানুষের মাথাপিছু বর্তমান আয় ১০৫০ ডলার থেকে আড়াই হাজার ডলারে রুপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করা হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ এবং দারিদ্র্যের হার ২৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশে নিয়ে আসা এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। দেশ থেকে দারিদ্র পরিপূর্ণভাবে দূরীকরণের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্প-কারখানা স্থাপন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র পরিপূর্ণভাবে দূর করার লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে এতে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন। তবে এ রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামি পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার। এজন্য অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ উত্পাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানা চালু ও রুগ্ন শিল্পকে উত্পাদনে নেওয়ার পদক্ষেপ থাকবে। এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিদ্যুত্ উত্পাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বর্তমানকে বলেন, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথমসারির উন্নত দেশে উন্নীত করা। এ লক্ষ্যে সরকার আগের মেয়াদে অর্থাত্ ২০০৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রণয়ন করে পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১। এ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সরকার দেশকে প্রথমে মধ্যম আয়ের দেশে এবং পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশে দেশে রুপান্তরের পরিকল্পনা করছে। তিনি জানান, মধ্যম আয়ের এবং পর্যায়ক্রমে উন্নত রাষ্ট্রে রুপান্তরের লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশ বছর মেয়াদি রোডমাস্টার প্ল্যান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধিতে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বাড়তি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে মানুষের মাথাপিছু বর্তমান গড় আয় মাথাপিছু আয় ১০৫০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। পরিকল্পনায় দেশের কৃষি ও শিল্প খাতকে আরো বেশি উত্পাদনমুখী করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মহাপরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। এজন্য উন্নত পদ্ধতির কৃষি উত্পাদনের বিষয়টির ওপর বাড়তি জোর দেয়া হবে। পাশাপাশি ভারি ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ও আমদানি নির্ভরতা হ্রাসের উদ্যোগ থাকছে। এর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশে দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের মাধ্যমে এবং নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি করা হবে। যা অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আর এই মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুত খাতের বর্তমান উত্পাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সাল নাগাদ ২৪ হাজার মেগাওয়াট করা হবে। অন্যদিকে অর্থনীতিতে শিল্পায়নের আয়ের হিস্যা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ এবং শ্রমশক্তি ১৫ থেকে ২৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজের সবক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও বিকেন্দ্রীকরণের ওপর বাড়তি জোর দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়াতে পদক্ষেপ থাকছে এ মহাপরিকল্পনায়।
সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে অর্থমন্দা মোকাবেলায় সাফল্য, বিদ্যুত্-জ্বালানি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কৃষি , খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্প-বাণিজ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রবাসী কল্যাণ, নারী ও শিশু উন্নয়ন , ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও জনশক্তি রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকার পুর্নগঠন ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণসহ যেসব খাতে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সরকার ২০২১ সালের আগেই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে কাজ করছে। তিনি বলেন, রূপকল্প-২০২১ সামনে রেখে ২০০৯ সালে সরকার আগের মেয়াদে যে অভিযাত্রা শুরু করেছিল, তা বজায় রেখে দেশকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে দেশকে মুক্ত করার বর্তমান সরকারে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিষয়টি পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। এদিকে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। যার মধ্যে মানব সম্পদ খাত-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট খাতে মোট বরাদ্দের ২১.৫৮ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ৩০.১৫ শতাংশ (যার মধ্যে রয়েছে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৪.৬৯, যোগাযোগ খাতে ৯.২৪ শতাংশ, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে ৪.৬২ শতাংশ) বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এসব বরাদ্দ সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে বলে আশা করছে সরকার। সরকারের এ পরিকল্পনায় ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও কৃষি খাতের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক সংস্কার ও বিকেন্দ্রীকরণের ওপর বাড়তি জোর দেয়া হচ্ছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশ কষ্টসাধ্য হবে। এব্যপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দারিদ্র্য ও বৈষম্য পরিপূর্ণভাবে দূর করতে হবে। দেশকে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে উন্নীত করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পদক্ষেপ, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, বিনিয়োগের হার বৃদ্ধিতে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) বৃদ্ধি, বৈদেশিক সহায়তা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে বিশেষ পদক্ষেপ।
প্রসঙ্গত, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়।