Published in The Daily Manobkantho on Friday, 12 December 2014.
উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসার ইঙ্গিত
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগের বছরগুলোতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে যে হতাশা ছিল সেটা এখন কাটতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসছে। নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪ শতাংশের বেশি। পাশাপাশি বেড়েছে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। দীর্ঘদিন পর শিল্প খাতে ঋণ বাড়ার এই ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ ফিরে আসার লক্ষণ দেখছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মোট শিল্পঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৪৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ১ম ত্রৈমাসিকের তুলনায় ৫৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। মোট শিল্পঋণ বিতরণের মধ্যে মেয়াদি ঋণ বিতরণের পরিমাণ হয়েছে ১২ হাজার ৮০৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। অর্থনীতিতে গতি ফেরা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানবকণ্ঠকে বলেন, শিল্পের মেয়াদি ঋণ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তবে এর সঙ্গে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়াকে আশঙ্কাজনক হিসেবে দেখছেন তিনি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে যে হতাশা ছিল সেটা এখন কাটতে শুরু করেছে। শিল্পের মেয়াদি ঋণ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ায় বোঝা যাচ্ছে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে এখন তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানও বাড়বে।
একই বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ২০১২ ও ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল ২০১৪ সালে তা কাটতে শুরু করেছে।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ সময়ে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। দেশীয় বিনিয়োগের প্রধান নিয়ামক শিল্পের মেয়াদি ঋণও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আহরণে গতি পেয়েছে। নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে মূল্যস্ফীতিও। সব মিলে সার্বিক অর্থনীতির মূল সূচকগুলো এখন ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে গতি ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির কিছু কিছু সূচকে ইতিবাচক ধারা দেখা গেলেও খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা এখনো অর্জিত হয়নি। তাই অর্থনীতিতে এখন মিশ্র অবস্থা বিরাজ করছে বলে তারা মন্তব্য করেন। অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোকে ধরে রাখতে পারলে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পুরোপুরি আস্থা ফেরাতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি এবং শিল্পের মেয়াদি ঋণ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কেননা দেশে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন করলেই মেয়াদি শিল্পঋণের চাহিদা বাড়ে। দেশে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে মেয়াদি শিল্পঋণ আর মেয়াদি শিল্পঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির বৃদ্ধিকে মূল নিয়ামক হিসেবে গণ্য করা যায়। ক্রমেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিকট ভবিষ্যতেও মেয়াদি শিল্পঋণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে ইতিমধ্যেই আভাস দিয়েছে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার এবং নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি নতুন শিল্প স্থাপনে অন্যতম বাধা। সরকার পরিকল্পিতভাবে যদি এসব বাধা দূর করতে পারে তাহলে দেশের শিল্প খাতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিল্পঋণ বিতরণের পাশাপাশি চলতি মূলধনী ঋণ বিতরণের পরিমাণও বেড়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে চলতি মূলধনী ঋণ বিতরণের পরিমাণ হয়েছে ৩৯ হাজার ২৩৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬২ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি। মোট মেয়াদি শিল্পঋণ বিতরণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মূল ভূমিকা পালন করেছে। অপর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোতে ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন। একই সময়ে ৯১ কোটি ৭২ লাখ ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের একই সময়কালে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে উদ্যোক্তারা এলসি খোলেন ৯৭ কোটি ১৬ লাখ ডলারের আর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭১ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের এলসি। ফলে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ আর এলসি নিষ্পত্তিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ২০ শতাংশ। একই সময়কালে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ আর নিষ্পত্তিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ।
বিনিয়োগ বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে স্থানীয়ভাবে নিবন্ধিত প্রকল্পগুলোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬৭ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বিদেশি প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ১১৭ শতাংশ। যাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৩ শতাংশ আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ। প্রথম তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতেও গতি ফিরেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্র (এলসি) বেড়েছে প্রায় ১২ দশমিক ০১ শতাংশ আর এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে সাড়ে ৭ শতাংশ ও ২৮ শতাংশ আর শিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ ও ৪ শতাংশ। তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসের হিসাবে প্রকৃত আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ।