Published in Daily Bortoman on Monday, 19 May 2014.
ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে টানাই এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ
বর্তমান প্রতিবেদক
নতুন সরকার গঠন হয়েছে প্রায় সাড়ে চার মাস। এ সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা না হলেও গত কয়েক মাসে গুম, খুন, অপহরণ লেগেই আছে। এর জের ধরে বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে হরতাল ও পরিবহন ধর্মঘটের মতো ঘটনা। এমন বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ ঘরে বসে না থাকলেও ব্যবসায়ীরা প্রায় হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাই তাদের চিন্তা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগ আকৃষ্টের জন্য বাজেটে নানা উদ্যোগ রাখার পাশাপাশি বাজেটের বাইরেও সরকারকে রাজনৈতিকভাবে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর মাধ্যমেই ব্যবসায়ীদের আস্থায় এনে ব্যাংকে জমানো টাকা খরচ করে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আর এটিই আগামী ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি ব্যবসায়ীদের আস্থা। নির্বাচনের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না থাকলেও ব্যবসায়ীদের মনে ভবিষ্যত্ অস্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা করেছে। যে কোনো সময়ই রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এ ছাড়া অবকাঠামোগত আগের সঙ্কটগুলো রয়েই গেছে। নতুন কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া পুরোদমে শুরু না হলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে উত্সাহ পাচ্ছেন না। কারণ কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তোলা কারখানা গ্যাস-বিদ্যুত্ না পেলে অচল পড়ে থাকবে। আর বাড়তে থাকবে ঋণের সুদ। ব্যবসায়ীরা আর এমন পরিস্থিতিতে পড়তে চান না।
তারা বলছেন, আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না হয়, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য আরও বেশি দুর্বল হয়ে যায়, ব্যাংক সুদের হার আরও বাড়তে থাকে, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। তাহলে অবশ্যই এক ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হবে; ফলে রাজস্ব আয় ও বিনিয়োগ কমতে পারে এবং সরকারের ব্যয় করার ক্ষমতা কমে যাবে। গত কয়েক বছর ধরে সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা বললেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীল উন্নতি, সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা যাবে না।
এনবিআর ও এফবিসিসিআই আয়োজিত আলোচনা সভায় আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসায়ীরা ৬১৭টি প্রস্তাব দিয়েছেন। ব্যক্তিপর্যায়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি শিল্প ও বিনিয়োগ উত্সাহিত করতে শুল্ক সমন্বয়ের এসব প্রস্তাব করেছেন তারা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য প্যাকেজ ভ্যাট অপরিবর্তনীয় রেখে ক্ষেত্রবিশেষে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিনিয়োগ বাড়ানো আগামী বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে দেয়ার কথা সরকার গত কয়েক বছর ধরেই বলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কিছু ঘটেনি। সঙ্গে রয়েছে সুশাসনের অভাব ও শ্রমিকদের অদক্ষতা। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এসব দিকে নজর দেয়ার কথা বলেন তিনি। তাই সরকারকে ভেবেচিন্তে দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। না হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়ানো কঠিন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের আয়ের খাত হলো রাজস্ব আহরণ, সঞ্চয়পত্র, সরকারি কোম্পানির মুনাফা, বৈদেশিক সহায়তা এবং ব্যাংক ঋণ। বাজেটের চ্যালেঞ্জ সামগ্রিক অর্থনীতির আলোকে বিচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমত আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু এই অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না হয়, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য আরও বেশি দুর্বল হয়ে যায়, ব্যাংক সুদের হার আরও বাড়তে থাকে, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। তাহলে অবশ্যই এক ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হবে, যার ফলে রাজস্ব আয় ও বিনিয়োগ কমতে পারে এবং সরকারের ব্যয় করার ক্ষমতা কমে যাবে।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহ্মদ বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। কারণ আমাদের অর্থনীতি হচ্ছে বেসরকারি খাত কেন্দ্রিক। বিগত অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ কমেছে জিডিপির ১ শতাংশ। বিনিয়োগের মূল বাধা হচ্ছে দুর্বল কাঠামো। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকের উচ্চসুদ, বিদ্যুত্ ও জ্বালানির অপর্যাপ্ততা, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প প্লটের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি বাধাগ্রস্ত করেছে। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে এবং আগামী বাজেটে এ বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আরও বলেন, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যই আমাদের সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের সব স্তরের কার্যক্রমে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি, অন্যথায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হবে না।
দেশের বিনিয়োগে স্থিতিশীলতা আনতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, সম্প্র্রতি নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আইনের শাসন নিশ্চিত না করলে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না।
ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণের জোর দাবি জানিয়ে এ কে আজাদ বলেন, ‘আমি নিজে একজন ব্যাংকার। সরকার যদি আইন করে দেয় তবে প্রত্যেকেই তা মেনে চলতে বাধ্য। ব্যাংকারদের ইচ্ছা থাকলেও সরকারি নীতির কারণে তারা তা করতে পারছে না।’
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জসিম উদ্দিনও প্লাস্টিক খাতের গতিশীলতায় নগদ সহায়তার দাবি জানিয়ে বলেন, এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিতে হবে এবং আমদানিকৃত প্লাস্টিকের শুল্ক স্তর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নির্ধারণ করা না হলে স্থানীয় শিল্প টিকে থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুশের্দী বলেন, রপ্তানি বাড়াতে খাতভিত্তিক ক্ষেত্রবিশেষে প্রণোদনা দিতে হবে। এ ছাড়া ক্ষদ্র ব্যবসায়ীদের প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখারও দাবি জানান তিনি।
মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদ অর্থাত্ ২০০৯ সাল থেকে বিনিয়োগ কমছে। অথচ সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২০১০ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২০১৫ অর্থবছরে ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮-১০ শতাংশ অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে বিনিয়োগের হার দ্রুত বাড়াতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হয় তাহলে বিনিয়োগের হার ৩২ শতাংশ করতে হবে।’
তবে পরিকল্পনার বিপরীতে বিনিয়োগের প্রকৃত চিত্র খুবই হতাশাজনক। পরিকল্পনায় প্রাক্কলিত বিনিয়োগের তুলনায় প্রকৃত বিনিয়োগ কমছেই। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরটি ছিল পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তৃতীয় বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, তৃতীয় বছরে বিনিয়োগের হার হয়েছে ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিগত বছরে বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ হার যথাক্রমে ৩১ ও ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। আর পরিকল্পনার প্রথম ও দ্বিতীয় বছরেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ হয়নি।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, সবচেয়ে দুরবস্থা বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। ২০০৯ সালে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের হার এটাই সর্বনিম্ন তবে সরকারি বিনিয়োগ ২০০৯ সালে জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।