Published in Bonik Barta on Saturday, 11 July 2015.
শক্তিশালী টাকায় দুর্বল হচ্ছে রফতানি খাত
মীর মনিরুজ্জামান ও বদরুল আলম
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ডলারের বিপরীতে ইউরো, কানাডিয়ান ডলার, ভারতীয় রুপি, পাকিস্তানি রুপি অবমূল্যায়িত হয়েছে। অন্যদিকে দেড় বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। এতে আমদানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ কিছুটা লাভবান হলেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে রফতানি বাণিজ্যে। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের দাম বেশি থেকে যাচ্ছে।
এদিকে বাজার থেকে নিয়মিত ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দাম ধরে রাখতে পরোক্ষ ব্যবস্থা হিসেবে এ পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার পরও টাকা শক্তিশালী হওয়ার প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের রফতানি খাত।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) তথ্যমতে, তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দর কমেছে ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ, পাকিস্তানি রুপি ২ দশমিক ৪৫ এবং ভিয়েতনামি মুদ্রা ডংয়ের দর কমেছে ২ দশমিক ২২ শতাংশ। কিন্তু ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার মান বেড়েছে ১ দশমিক ৯১ শতাংশ। অথচ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে ইউরোর মান কমেছে ২৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, কানাডিয়ান ডলার ১৭ শতাংশ এবং রাশিয়ান রুবলের কমেছে ৫৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
রফতানিকারকরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মুদ্রা অবমূল্যায়িত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী পণ্য কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে। ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের পণ্যের কাছে মার খাচ্ছে বাংলাদেশী পণ্য। পণ্যমূল্যের বিচারে আয় কিছুটা বাড়লেও প্রতিদ্বন্দ্বী ওইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
বাংলাদেশের মোট রফতানি লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ অর্জিত হয় তৈরি পোশাক খাত থেকে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। অথচ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের তুলনায় দুই, আড়াই বা তিন গুণেরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, ভারতের ১০ দশমিক ৫৮ ও পাকিস্তানের ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হলে সাধারণত রফতানি বাড়ে। ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান এর সুফল পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে টাকা অবমূল্যায়ন করা হলে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ যেহেতু তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে, তাই টাকার অবমূল্যায়ন অর্থনীতিতে কতটা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে, সেটা ভাবনার বিষয়। তিনি বলেন, রফতানির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে এবং দিয়ে যাবে।
রফতানি খাতের মূল পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের মতে, রানা প্লাজা ধসের পর এ শিল্পে নানা টানাপড়েন চলছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত পরিপালন ও কমপ্লায়েন্স ঠিক রাখতে কারখানার খরচ বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে শ্রমিকদের বেতন। কিন্তু খরচ বাড়লেও পোশাকের দাম বাড়াতে পারছেন না মালিকরা। কারণ ইউরোর দরপতনের কারণে আগের চেয়ে কম দামে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ নিতে হচ্ছে। যারা পারছে না, তাদের ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ইএবির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে এবং তার সুফলও পেয়েছে। ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের রফতানি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, সরকার রফতানি খাতকে অবহেলা করছে। ফলে রফতানি কমছে। রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে সরকারকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। টাকার মূল্যমান কমানো সম্ভব না হলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা তৈরির জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের জুলাইয়ে ৮১ দশমিক ৮১ টাকার বিনিময়ে ১ ডলার ক্রয় করা যেত। এর পর ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১ ডলারের মূল্য নেমে আসে ৭৯ দশমিক ৭৫ টাকায়। সে বছর মে মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য হয় ৭৭ দশমিক ৯৩ টাকা। এর পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ৭৭ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে ডলারের মূল্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, গত দেড় বছরে ডলারের চাহিদা তুলনামূলক কম ছিল। এ কারণে ডলারের দাম ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত ডলার কিনছে। কিন্তু তার পরও টাকা এখন শক্তিশালী অবস্থানে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ব্যাংক থেকে ডলার না কিনত, তাহলে ডলারের দাম ৭০ টাকার নিচে নেমে আসত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল বলেন, বাংলাদেশের টাকার সঙ্গে সম্পর্ক ডলারের। কিন্তু ইউরোর দাম তো অনেক কমে গেছে। ইউরোর সঙ্গে টাকার সম্পর্ক হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। ইউরোপের অবস্থা খারাপ হওয়ায় রফতানি কমে গেছে। ফলে ডলারের মান নিয়ে প্রশ্ন আসছে। যদি চাহিদা তৈরি হয়, নিশ্চয়ই ডলারের দাম বেড়ে যাবে। আমরাও বাজারে ডলার সরবরাহ করব। তবে বাজারে এমন অবস্থা নেই, সহসা হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টাকা শক্তিশালী হওয়ার গতি পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ৭০-৭১ টাকায়ও ডলার কেনা যেত। টাকা শক্তিশালী হওয়ার প্রভাবে রফতানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছেন আমদানিকারকরা। আর তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ আমদানিমুখী রফতানিকারকই।
শুধু রফতানিকারকদের বিবেচনায় নিয়ে ডলারের ফিক্সড রেট বা দ্বৈত কোনো ব্যবস্থা প্রণয়ন করা যাবে বলে আমি মনে করি না— এমন মন্তব্য করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের দ্বৈত নীতি বা ব্যবস্থার প্রচলন দেশে অনেক আগে থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সবদিক বিবেচনায় রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ প্রণোদনা ছাড়া অন্য কোনো কার্যকর উপায় নেই।