Published in Kaler Kantho on Tuesday, 27 May 2014.
সাক্ষাৎকার: বাংলাদেশে রাজস্ব ব্যয় ও বিভিন্ন উন্নয়ন ব্যয়ের চাহিদা যেমন আমাদের স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, জ্বালানি এগুলোয় যে চাহিদা, তা সামনের সময়গুলোতেও ক্রমান্বয়ে বাড়বে। বাজেটের পরিমাণগত দিকের চেয়ে, আমার মনে হয়, গুণগত উৎকর্ষের দিক মাথায় রাখতে হবে
– অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক
প্রায় ২৫০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষিত হচ্ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রেখে এ বাজেট প্রণীত হচ্ছে বলে কি মনে করেন?
এ বাজেটে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো অসামঞ্জস্য আমি দেখি না। আমাদের মতো দেশে আয়ের সুযোগ বাড়ছে, জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ছে, উন্নয়নের ব্যয়ও তেমন উত্তরোত্তর বাড়ছে। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক চাহিদার কথা মাথায় রেখেই এ বাজেটের পরিমাণগত দিক বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করি। তবে বণ্টনের ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত উভয় দিকই বিবেচ্য। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার মাধ্যমে এ বাজেটের গুণগত-পরিমাণগত বাস্তবায়ন যাতে করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। কারণ বাংলাদেশে রাজস্ব ব্যয় ও বিভিন্ন উন্নয়ন ব্যয়ের চাহিদা, যেমন আমাদের স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, এগুলোয় যে চাহিদা, তা সামনের সময়গুলোতেও ক্রমান্বয়ে বাড়বে। বাজেটের পরিমাণগত দিকের চেয়ে, আমার মনে হয়, গুণগত উৎকর্ষের দিক মাথায় রাখতে হবে।
এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে না। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে অর্থপাচার প্রবণতা বেড়ে যাবে। কালো টাকা সাদা না করার সরকারি এ সিদ্ধান্তকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এ বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান যদি রাখা না হয়, তবে আমার মনে হয়, এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। আমরা সবসময়ই বলে আসছি, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। এটা সরকারের জন্য কিংবা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হয় না। কারণ এটা অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা, সর্বোপরি রাজস্ব শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত তৈরি করে, রাজস্ব সিস্টেম নষ্ট করে। যারা প্রকৃত অর্থে সৎভাবে রাজস্ব দেন, কালো টাকা সাদা করার প্রবণতা প্রকৃত রাজস্বদাতাদের অনুৎসাহিত করে। তা ছাড়া কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে সরকার যে রাজস্ব পায়, আমরা দেখছি যে এটা থেকে ভালো কোনো আয়ও আসে না। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকায় অনেকেই মনে করেন, এখন রাজস্ব না দিয়ে পরে দিলেও চলবে, সুতরাং এখন দেব কেন? ফলে অর্থনীতিতে এটার একটা নেতিবাচক অবস্থান তৈরি হয়। আর অর্থপাচারের যে বিষয়টি, সেটি এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। তবে পাচার বন্ধ করার জন্য অন্যান্য যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সেগুলো সরকারকে নিতে হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও যে অর্থ পাচার বন্ধ হয় না, তার প্রমাণ তো আমরা গত কয়েক বছর ধরে দেখেছি। কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে খুব বেশি টাকা সরকারি কোষাগারেও আসেনি কিংবা মূল অর্থনীতির স্রোতধারায় এ টাকা খুব বেশি জমাও হয়নি।
স্থায়ী অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্বার্থে কৃষি-শিল্পসহ এবারের বাজেটে কোন কোন ক্ষেত্রকে আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
বাজেট পেশ করা হলেই বোঝা যাবে নীতিনির্ধারণ যাঁরা করেন, তাঁরা কোন কোন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ বাজেটে কৃষি ও শিল্পকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার কতটুকু চেষ্টা থাকছে, সেটাও লক্ষণীয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন কোন খাতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটার ওপরেও ভবিষ্যতে অনেক কিছু নির্ভর করবে। যদি আমরা দেখি ভর্তুকির জন্য যে বরাদ্দ, সেখানে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি, তাহলে তার হিসাব-নিকাশ অন্য রকম হতে পারে। যদিও আশা করা যায়, এবার ভর্তুকি কিছুটা কম লাগবে। কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বর্তমানে স্থিতিশীল আছে, খাদ্যশস্যের দামও স্থিতিশীল। এদিক থেকে মনে হয়, ভর্তুকির বেলায় সরকার সুবিধাজনক একটা পর্যায়ে থাকবে। কৃষিতে যেসব বিনিয়োগ বাড়ানো ও কৃষিতে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়ার কথা, যেসব নিলেই কেবল কৃষিখাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আশা করা যায়।
এ ছাড়া স্থানীয় যেসব শিল্প আছে, সেগুলো কিছুটা হলেও একটা সংরক্ষণের মধ্যে থাকুক। ঢালাওভাবে যদি সম্পূরক শিল্প কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা স্থানীয় কোনো কোনো শিল্পের জন্য হয়তো সমস্যা তৈরি করবে। সরকার এ সব ব্যাপারে কী চিন্তাভাবনা করছে, সেটা তো আমরা কেউই এখনো জানি না। যেদিন বাজেট ঘোষণা করা হবে, সেদিন এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আমরা পাব। আমরা আশা করব, কৃষিখাতে, বিশেষত বৃহত্তর কৃষিখাতে যেখানে শস্যখাত আছে, লাইভস্টক, পোল্ট্রিখাত আছে, ফিশারিজ আছে, সেগুলোসহ কৃষিবহির্ভূত যে সব খাত আছে, সেগুলোতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত দেওয়া হোক। আমার বিশ্বাস, এগুলোতে বরাদ্দ বাড়বে। তবে তার বাস্তবায়ন যাতে প্রকৃত হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। গ্রাম থেকে অনেক কর্মসংস্থান এখন শিল্পখাতের জন্য আসছে। তাই এসএমই-র জন্য উদ্যোগ থাকুক, সেটাও আশা করব। সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য সুবিধা যদি তুলে নেওয়া হয়, তাহলে এসএমই খাত একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সে ক্ষেত্রে এসএমই-র জন্য যে সহায়তাগুলো দরকার, সেগুলোতে যদি বরাদ্দ বাড়ে তাহলে তা শিল্পবিকাশে সহায়ক হবে। সরকারের শুল্ক কাঠামো কি রকম তা না দেখে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু এখনই বলা সম্ভব নয়।
বিরাট পরিসরের এ বাজেট কেবল ঘোষণা নয়, বাস্তবায়ন করাও হবে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। বাজেটের সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে সরকার তার বাজেট বাস্তবায়নের এ চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবিলা করবে বলে মনে করেন?
বাজেটের আকার ক্রমান্ব্বয়ে বাড়ছে, রাজস্ব বাজেটের আকার বাড়ছে, উন্নয়ন বাজেটের আকার বাড়ছে। উন্নয়ন প্রশাসনকে সাজানোর জন্য সরকার নতুন সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট করার কথা বলেছিল, যেটার জন্য সরকার, আশা করি, উদ্যোগ নেবে। আশা করব, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। সংস্কার কর্মসূচির আওতায় কোন কোন খাতগুলোর সংস্কার ইতিমধ্যে করা হয়েছে, কতটুকু পূরণ হলো, কতটুকু সংস্কার হয়নি, কোনগুলোর কার্যক্রম চলমান আছে, অর্থমন্ত্রী গত বাজেটে এ সংক্রান্ত একটা ধারণা দিয়েছিলেন। আশা করি, এবারের বাজেটেও এ ব্যাপারে একটা সুষ্পষ্ট ধারণা পাব। এর মাধ্যমে উন্নয়ন সক্ষমতার প্রশ্নটি ও তার উত্তর আমাদের সামনে আরো পরিষ্কার হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : আলমগীর কবীর