Published in Samakal on Monday, 19 May 2014.
অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই
বিশেষ প্রতিনিধি
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সহিংস রাজনীতির কবলে পড়ে অর্থনীতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল, যার ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। তবে বিনিয়োগকারী ও ভোক্তা পর্যায়ে এখনও দুর্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় নিতে হলে এই অনিশ্চয়তা কাটাতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর আয়োজিত অর্থনীতি ও বাজেট বিষয়ে লাইভ ‘টক শো’ সিরিজের প্রথম দিনের আলোচনায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এমনই পরামর্শ দিয়েছেন। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আগামী বাজেটে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে নীতির ধারাবাহিকতা থাকবে এমন চিন্তা থেকে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ মেয়াদে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে রোববার সন্ধ্যায় প্রচারিত এ অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও আর্থিক কাঠামো’। এতে অংশ নেন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাসান জামান। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। সমকাল পাঁচ দিনের এ আয়োজনের প্রিন্ট মিডিয়া সহযোগী।
ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত তিন বছর ধরে কমছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়ে অনেক নিচে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রথমে দরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে আগামী বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শুধু বরাদ্দ বাড়ালে হবে না, অর্থ ব্যয়ের
গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। বাস্তবায়ন পর্যায়ে দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। পরিবেশ সৃষ্টিই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য দরকার সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ। বিনিয়োগকারীরা নীতির ধারাবাহিকতা চান। সরকারকে সেই দিকটায় বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএসইসিসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে, কর্মসংস্থান বাড়াতে এসএমইকে আরও উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কর কাঠামো বেসরকারি খাত বান্ধব হতে হবে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতা রয়েছে তাকে কাজে লাগাতে হলে বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধির ত্বরণ সৃষ্টি করতে হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে যে দুশ্চিন্তা ছিল তা কিছুটা কেটেছে। তবে দুর্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে কম যাচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে বেরোতে হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি সমঝোতামূলক নিষ্পত্তি দরকার।
হাসান জামান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে হবে। মনে হয় শেষ পর্যন্ত এমনই প্রবৃদ্ধি হবে। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশের মতো হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি এখনও উচ্চ অঙ্কে : অর্থনীতির সূচকগুলোর সাম্প্রতিক অবস্থা পর্যালোচনায় মোস্তাফিজুর রহমান মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের নিচে নেমেছে উল্লেখ করে এটিকে ইতিবাচক আখ্যা দেন। তবে হাসান জামান মনে করেন, মূল্যস্ফীতি এখনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, সর্বশেষ হিসাবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের নিচে নামবে বলে তিনি আশাবাদী। ড. সালেহ উদ্দিন অবশ্য বলেন, মূল্যস্ফীতি শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর সঙ্গে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পৃক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমে আসার প্রবণতাকে বাস্তবতার সঙ্গে ঠিক মেলে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মির্জ্জা আজিজ তার বক্তব্যে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সরকারের ব্যাংক ঋণের সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে আগামী বাজেটে অপেক্ষাকৃত কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকার সর্বোচ্চ ব্যাংক ঋণ নেয় এবং এর পরের অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়।
রাজস্ব প্রণোদনা বনাম বিনিয়োগ : মির্জ্জা আজিজ মনে করেন, বাজেটে বেসরকারি খাতের জন্য বিভিন্ন কর সুবিধা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে তেমন ভূমিকা রাখবে না। কেননা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না। সুতরাং বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবে তিনি আগামী বাজেটে করপোরেট কর কিছুটা কমানোর পক্ষে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য হ্রাসকৃত করপোরেট করের কিছু ফল পাওয়া গেছে বলে মনে করেন সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, করপোরেট কর কিছু ক্ষেত্রে (যেমন ব্যাংক) কমানো দরকার। তবে শুধু হার কমালে হবে না, সবাই যাতে কর দেয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন : ড. হাসান জামান মনে করেন, পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দু’তিন বছর পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ অঙ্কের ঘরে পেঁৗছবে। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও একই ধরনের মত দিয়ে বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে গেছে। এর বড় কারণ পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়া। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) এবং শিল্প পার্ক নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে হবে। মির্জ্জা আজিজ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির গুণগত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। বিনিয়োগের এই বাস্তবতায় আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী কি-না প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা ভালো। তবে তার বাস্তব ভিত্তি থাকতে হবে। বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে এত বড় অঙ্কের প্রবৃদ্ধি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।