Published in Orthoniti Protidin on Tuesday, 2 September 2014.
ক্রমে বাণিজ্য বৈষম্য বাড়ছে ডি-এইটে
আলতাফ হোসেন
ঘাটতিতে পাঁচ, উদ্বৃত্তে তিন দেশ
মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ডি-এইট (ডেভেলপিং এইট) অর্থনৈতিক জোটের বাণিজ্যে সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। জোটভুক্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সীমিত রফতানির তুলনায় বিশাল আমদানি বাণিজ্যের কারণে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। আর বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ২০১৩ অনুযায়ী, ডি-এইট রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। প্রথম স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, দ্বিতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া ও তুর্কি রয়েছে তৃতীয় স্থানে। এছাড়া চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইরান, নাইজেরিয়া, মিসর ও পাকিস্তান।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডি-এইট জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২০১২ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৭৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। আর প্রথম স্থানে থেকে ইন্দোনেশিয়া পণ্য রফতানি করেছে ১৭ হাজার ৬২ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া মালয়েশিয়া ১৫ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন ডলার, তুর্কি ১৪ হাজার ৯৪১ মিলিয়ন ডলার, ইরান ১৪ হাজার ২৭৯ মিলিয়ন ডলার, নাইজেরিয়া তিন হাজার ১২৫ মিলিয়ন ডলার, মিসর দুই হাজার ১৭৮ মিলিয়ন ডলার ও পাকিস্তান দুই হাজার ১৭১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে।
আমদানির ক্ষেত্রে ডি-এইট জোটের দেশগুলোর মধ্যে তুর্কি ১৭ হাজার ২৬০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে প্রথম সারিতে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির পণ্য আমদানির পরিমাণ ১৬ হাজার ৬৩৭ মিলিয়ন ডলার। ১৪ হাজার ৮১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইরান। এছাড়া মালয়েশিয়া ১১ হাজার ৪৭৯ মিলিয়ন ডলার, মিসর ৬ হাজার ৭১৩ মিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান পাঁচ হাজার ৯৮০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ তিন হাজার ৮৬৭ মিলিয়ন ডলার এবং নাইজেরিয়া এক হাজার ৫১৮ মিয়িয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আটটি দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাঁচটি দেশের ঘাটতি রয়েছে। আর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে তিনটি দেশের। জোটভুক্ত এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ পাকিস্তান ও তুর্কি কখনোই বাণিজ্য ঘাটতি এড়াতে পারেনি। আর মালয়েশিয়া কখনো বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েনি। প্রথমবারের মতো বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে ইরান। ইন্দোনেশিয়া, মিসর ও নাইজেরিয়া কখনো ঘাটতি ও কখনো উদ্বৃত্তের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য সময় পার করেছে।
২০১২ সালে চার হাজার ৫৩৫ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক। এরপর পাকিস্তান তিন হাজার ৮০৯ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ তিন হাজার ১৩২ মিলিয়ন ডলার, তুর্কি দুই হাজার ৩১৯ মিলিয়ন ডলার এবং ইরান ৫৩৫ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি করে। এছাড়া ৪ হাজার ৬৪৩ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে নাইজেরিয়ার। আর মালয়েশিয়ার তিন হাজার ৯৪০ মিলিয়ন ডলার ও ইন্দোনেশিয়ার ৪২৫ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে।
অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে আমদানি-রফতানিতে জোট মোট বাণিজ্য করে চার হাজার ৬২০ মিলিয়ন ডলার। তবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার ১৩২ মিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০১১ অর্থবছরে ডি-এইট দেশগুলোতে মোট রফতানি করে ৯০৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর আলোচ্য সময়ে আমদানি করে চার হাজার ৪৩ মিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার ১৩৬ মিলিয়ন ডলার।
২০১০ অর্থবছরেও ৮০২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানির বিপরীতে আমদানি করে দুই হাজার ৭৫৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ওই বছর মোট আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয় তিন হাজার ৫৬১ মিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ হয় এক হাজার ৯৫৭ মিলিয়ন ডলার।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ জোটের দেশগুলোতে মাত্র ৫০৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। এর বিপরীতে জোটভুক্ত দেশ থেকে আমদানি করে দুই হাজার ২৯ মিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে এক হাজার ৫২২ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি পড়ে।
ডি-এইট অর্থনৈতিক জোটের লক্ষ্য সদস্য দেশগুলোর সম্পদ ও সামর্থ্য নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান এবং সমন্বিত উৎপাদন ও বাণিজ্য-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জোটের সবার আর্থসামাজিক উন্নতি নিশ্চিত করা।
জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর আলাপ-আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত আটটি মুসলিম দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের উপস্থিতিতে ডি-এইট নামে একটি নতুন অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য ৭টি দেশের মধ্যে রয়েছে মিসর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং তুরস্ক।
দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। অন্য দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের কাতারে রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ আবার নতুন শিল্পায়িত দেশ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে।
ডি-এইটের মধ্যে বাণিজ্য না বাড়ার কারণ হিসেবে কূটনৈতিক ব্যর্থতা, বাংলাদেশী পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকা ও শুল্কবাধাকে দায়ী করেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ, সাবেক কূটনীতিক ও ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, এক তৈরি পোশাক দিয়েই অনেক দূর এসেছে বাংলাদেশ। এখন সময় এসেছে পণ্যের সম্ভাব্য বাজার খুঁজতে এসব জোটকে কাজে লাগানো, প্রচলিত পণ্যসহ অন্যান্য নতুন পণ্যের প্রতিযোগিতাপূর্ণ দামের সঙ্গে মান উন্নয়ন ও তার সঠিক প্রচারণার। এক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা ও গবেষণা খুব জরুরি।
রফতানিকারকরা বলছেন, ডি-এইট দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি বাড়ানোর চমৎকার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, মিসর এবং পাকিস্তানে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমরা নানা কারণেই সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি না। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে লোকাল ভ্যালু এডিশনের শর্তটি। ডি-এইট জোটে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে লোকাল ভ্যালু এডিশন যদি ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হতো, তাহলে পণ্য রফতানি অনেকটাই বেড়ে যেত বলে মনে করছেন তারা।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের রফতানি কাঠামো এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। ডি-এইটভুক্ত দেশগুলোতে অনেক বাঙালি আছে। সেখানে যেসব পণ্য চাহিদা রয়েছে রফতানি সক্ষমতায় সেুগলো বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, বাণিজ্য বৃদ্ধির স্বার্থেই এ ধরনের বাণিজ্য ফোরামগুলো থেকে সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য রফতানিকারকদের পণ্যে বহুমুখিতা আনতে হবে, পাশাপাশি সরকারকে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা তুলে নেবার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আমদানির বিকল্প বাজার হিসেবেও দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।