Published in Prothom Alo on Friday, 28 August 2015.
২০০ কোটি ডলারের ভারতীয় ঋণ
শর্তে রাজি নয় বাংলাদেশ
জাহাঙ্গীর শাহ
ভারতের ২০০ কোটি ডলার ঋণের কঠিন শর্ত মানতে রাজি নয় বাংলাদেশ। সম্প্রতি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংকের পাঠানো ঋণচুক্তির খসড়ায় বলা হয়েছে, এ অর্থ দিয়ে যে প্রকল্পই নেওয়া হবে, এর ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ চায় এ ঋণের টাকায় যেসব পূর্ত প্রকল্প নেওয়া হবে, এর ৫০ শতাংশ মালামাল অভ্যন্তরীণ বাজার বা ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে আনা হবে। আর পণ্য সংগ্রহের প্রকল্পে ৬০ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আনা যেতে পারে।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই চুক্তির এ শর্তের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে ঋণের শর্ত নিয়ে দর-কষাকষি করা হবে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে। ইআরডির অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, পূর্ত কাজের ক্ষেত্রে ভারত থেকে ৭৫ শতাংশ আমদানি করা হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হবে।
ভারতের ঋণের অর্থ দিয়ে ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে আটটিই পূর্ত প্রকল্প। এগুলো হলো রেল যোগাযোগ খাতের পার্বতীপুর-কাউনিয়া পর্যন্ত মিটারগেজ লাইনকে ডাবল গেজে রূপান্তর; খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন নির্মাণ; সৈয়দপুর রেল কারখানা উন্নয়ন; বিদ্যুৎ খাতের বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন নির্মাণ; আশুগঞ্জ নৌ কনটেইনার বন্দর স্থাপন; আশুগঞ্জ বন্দর-আখাউড়া স্থলবন্দর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প; চারটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন। এক্সিম ব্যাংকের শর্ত মানলে, ভারত থেকে ইট, বালু, সিমেন্টসহ যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী এনে ভারতীয় ঠিকাদারকে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
অন্য প্রকল্পগুলো হলো পরিবহন খাতের বিআরটিসির ৫০০ ট্রাক কেনা; ৫০০ বাস (৩০০ দ্বিতল ও ২০০ আর্টিকুলেটেড) কেনা; সড়ক ও জনপদ বিভাগের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আরও দুটি সেবা প্রকল্প রয়েছে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম এলওসি-এর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, শর্ত মানতে গিয়ে বেশ কিছু অসুবিধা হয়েছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যে দামে পণ্য দিতে চেয়েছে, অন্য দেশ থেকে এর চেয়ে কমে পাওয়া যেত। এ জন্য বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘প্যারিস ঘোষণা অনুযায়ী, যদি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভারতের কাছ থেকে শর্তহীন ঋণ পাওয়া যেত, সবচেয়ে ভালো হতো। এর ফলে ভারতের ঋণের টাকায় আমরা অন্য দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্য সংগ্রহ করতে পারতাম। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করার সুযোগ তৈরি হতো।’
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ভারত যদি ৬ শতাংশ সুদ ধরে শর্তহীন ঋণ দিত, তবে সেটা আরও কঠিন হতো। তাই স্বল্প সুদের এ ঋণে যতটা সম্ভব দর-কষাকষি করে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, কেনাকাটার শর্ত নিয়ে বাংলাদেশ যে প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে, তা ভারতকে রাজি করানো গেলে ভালো।
এদিকে এক্সিম ব্যাংকের আরেক শর্ত ছিল, যেকোনো পরামর্শ সেবা ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে নিতে হবে। এ শর্তও শিথিল করার পক্ষে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রস্তাব হলো, পরামর্শক সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যৌথ প্রতিষ্ঠান গঠন করা। এ প্রস্তাবও এক্সিম ব্যাংককে দেওয়া হবে।
ভারতের অন্যতম শর্ত হলো—এ ঋণের আওতায় কোনো প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। আর ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সব ধরনের কর মওকুফ থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের শুল্ক-কর সংক্রান্ত আইনে এ ধরনের মওকুফের সুযোগ নেই। তাই এ শর্তটি মানা যায় কি না, তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইআরডি।
গত জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ২০০ কোটি ডলারের সমঝোতা চুক্তি হয়, যা দ্বিতীয় এলওসি নামে পরিচিত। এর আগেও ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেই চুক্তির অর্থ ব্যবহারের শর্ত কিছুটা নমনীয় ছিল। তাতে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ৬৫ শতাংশ এবং অন্য প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকে করার শর্ত ছিল।
সমঝোতা চুক্তির সময় বলা হয়েছিল, দ্বিতীয় পর্যায়ের এ সহায়তার শর্ত আগের মতোই থাকবে। কিন্তু ঋণচুক্তির খসড়া পাঠানোর পর দেখা গেল, যেকোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ কেনাকাটাই ভারত থেকে করতে হবে।