Published in Manabzamin on Thursday, 12 March 2015.
বিনিয়োগে ধস
হামিদ বিশ্বাস
দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা অবরোধে দেশের অর্থনীতির প্রাণ ওষ্ঠাগত। কোথাও কোন বিনিয়োগ নেই। না ক্ষুদ্র, না বৃহৎ। সংকোচিত হয়ে আসছে অর্থনীতির সীমা। কমিয়ে আনা হচ্ছে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা। কাটছাঁট করা হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প। একদিকে ক্ষতির ফিরিস্তি, অন্যদিকে টাকার স্তূপ। বিভিন্ন সংগঠন পৃথক ক্ষতির খতিয়ান দেখাচ্ছে মুমূর্ষু অর্থনীতির। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলছে, ইতিমধ্যে ক্ষতি ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যরাও ক্ষতির পরিমাণ ১ থেকে দেড় লাখ কোটি টাকার মতো বলছে। তবে দুটো জিনিস চরম সত্য। অবরোধে হচ্ছে ক্ষতি, বিনিয়োগ না হওয়ায় জমছে টাকা।
জানা গেছে, সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে উদ্বৃত্ত তারল্য বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার মতো উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। বর্তমানে তার সঙ্গে আরও সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। এর মধ্যে একেবারে অলস পড়ে আছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছে, একেবারে অলস পড়ে থাকার পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার একটু বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে একেবারে অলস পড়ে থাকা টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৯৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা হলেও ১২ই ফেব্রুয়ারিতে তা গিয়ে ঠেকে ৩ হাজার ৩৭৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকায়। ধারণা করা হচ্ছে মার্চে ওই পরিমাণ আরও অনেক বেড়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করে বেকায়দায় পড়েছে। প্রচুর পরিমাণ অর্থ কোথায় খাটাবে কিংবা গ্রাহককে লাভ দেবে কিভাবে এসব দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেতে তারা ঝুঁকছে সরকারি বিল বন্ডের দিকে। সুযোগটি কাজে লাগাতে সরকারও এগিয়ে আসে। বর্তমানে দেশে কয়েক ধরনের বিল ও বন্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ড, ৩ মাস, ৬ মাস ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল এবং ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল। বর্তমানে ৫.২৫% ও ১২% নামমাত্র সুদের বিল-বন্ডে আটকে আছে ব্যাংকিং খাতের ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্যের বেশির ভাগই। বিল-বন্ডে বিনিয়োগের প্রচুর এ অর্থকে অল্প কিছু দিন আগেও বলা হতো অলস টাকা। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বিষয়টিকে সরকার ভাল চোখে দেখেনি। সে কারণে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকেও যে এক লাখ কোটি টাকাকে বলা হতো অলস ২০১৪ সালের সীমানা পেরিয়ে ২০১৫ সালে প্রবেশ করেই ওই বিশাল অলসই হয়ে গেল বিনিয়োগ। বলা হচ্ছে, এটাও এক ধরনের বিনিয়োগ। যদিও এ বিনিয়োগের সুফল দৃশ্যমান নয়। যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জানান, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই বলে বাধ্য হয়ে সরকারি খাতে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। বিনিয়োগের দিক থেকে মোট অর্থনীতির ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত। যেহেতু এ খাত এখন বিনিয়োগশূন্য। সেহেতু বলা যায় অলস টাকা জমছে। অন্যদিকে যেভাবে হোক সরকারি খাতে বিনিয়োগ থাকায় প্রচুর পরিমাণের এ অর্থকে অলস বলতে নারাজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। নগদ আছে ৩ হাজার কোটি টাকা। সেগুলোকে তারা বলছে অলস। তবে মূল কথা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ নেই। অলস টাকা জমছে। সার্বিক ব্যাখ্যায় এটাই প্রমাণ হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে; তার সাক্ষ্য খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ বোর্ডও দিচ্ছে। দীর্ঘ দিন থেকে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে চরম খরা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষত টানা হরতাল-অবরোধে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এ সময় কর্মসংস্থান, প্রকল্প ও বিনিয়োগে ব্যাপক ধস নেমেছে। এর মধ্যে খুব শোচনীয় অবস্থানে রয়েছে বিদেশী খাত। এ খাতের সব সূচক-ই নিম্নমুখী। এ ছাড়া দেশী খাতেরও বেশ কিছু সূচক নেতিবাচক ও সমানে সমান। বিনিয়োগ বোর্ডের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী গেল জানুয়ারিতে দেশে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ৩৫৭ জনের। যা আগের মাস ডিসেম্বরে ছিল ১৮ হাজার ৭৭৩ জনের। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে দেশে কর্মসংস্থান কমেছে ৩ হাজার ৪১৬ জনের। একইভাবে নিবন্ধিত প্রকল্পের সংখ্যাও কমেছে। এ সময় দেশী-বিদেশী প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে ১১৬টি। যা আগের মাসে ছিল ১২১টি। সে হিসেবে প্রকল্প নিবন্ধিতের সংখ্যা কমেছে ৫টি।
এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশের পরিস্থিতি খারাপ থাকায় বিদেশী বিনিয়োগের অবস্থা খুবই নাজুক। কর্মসংস্থানসহ সার্বিক সূচক কমার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশে বিরোধী জোটের হরতাল-অবরোধ চলছে। বিদেশীরা ভয়ে আসছে না। এর মধ্যে কর্মসংস্থান-বিনিয়োগ আশা করাটাই ভুল। তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে। এটা কম কিসের, প্রশ্ন তার।
বিনিয়োগ বোর্ডের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে বিদেশী কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৮৮৯ জনের। যা ডিসেম্বরে ছিল এক হাজার ৪২২ জন। সে হিসাবে বিদেশী কর্মসংস্থান কমেছে ৫৩৩ জনের। একই সঙ্গে কমেছে অপর দুই সূচকও। এ সময় বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৩২১ কোটি টাকা। যা আগের মাসে ছিল ৩৩৪৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে বিদেশী খাতে বিনিয়োগ কমেছে ৩০২৭ কোটি টাকা। এ খাতের প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে ৯টি। যা আগের মাসে ছিল ১৫টি। কমেছে ৬টি। বিওআই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, জানুয়ারিতে দেশি প্রকল্পের নিবন্ধন হয়েছে ১০৭টি। যা আগের মাসে ছিল ১০৬টি। এ সূচকে কিছুটা বাড়লেও ব্যাপক কমেছে কর্মসংস্থানে। এ সময় দেশী কর্মসংস্থান হয় ১৪ হাজার ৪৬৮টি জনের। যা আগের মাসে ছিল ১৭ হাজার ৩৫১ জনের। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে দেশী কর্মসংস্থান কমে ২ হাজার ৮৮৩ জনের।
সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণের হচ্ছে না। আর এটি না হওয়ারও কারণ দৃশ্যমান। দেশের অনিশ্চয়তা না কাটলে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ অর্জন করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ নেই। সে কারণে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঝুঁকছে সরকারি খাতে। এতে অর্থনীতি পিছিয়ে পড়বে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।