Published in Arthoniti Protidin on Monday, 15 September 2014.
গার্মেন্টসে বিদেশি বিনিয়োগ চান না দেশীয় উদ্যোক্তারা!
অর্থনীতি প্রতিবেদক
বহুমুখী সুবিধা পেয়ে আফ্রিকামুখী হচ্ছে পোশাক খাতের বিদেশি বিনিয়োগ। সর্বাপেক্ষা কম মজুরি, সস্তা দামে বিদ্যুৎ আর উন্নত অবকাঠামো সুবিধার কারণে ইথিওপিয়াসহ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশমুখী হচ্ছে পোশাকশিল্পের নতুন বিনিয়োগ। তবে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এ খবরে নির্বিকার দেশীয় গার্মেন্টস মালিকরা। তারা সাফ বলছেন, পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন থেকে নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগ সরে যাচ্ছে। কৌশলী হয়ে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে যে কোনো বিবেচনায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত, নতুন কর্মসংস্থান হতো, রফতানি বাড়ত, সেই সঙ্গে বাড়ত রাজস্ব আয়ও।
দেশীয় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চীনে বিনিয়োগকারীরা আফ্রিকার দিকে গেলে এশিয়ার দেশগুলোর জন্য তা ক্ষতির কারণ হবে। কেননা তখন ওই অঞ্চলের দেশগুলো পোশাকের বিশ্ববাজার দখল করে নিতে পারে। গার্মেন্টস শিল্প সম্পূর্ণভাবেই বিদেশি ক্রেতানির্ভর হওয়ায় ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার হারালে এ শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে।
তবে দ্বিমত রয়েছে দেশীয় গার্মেন্টস মালিকদের। তাদের মতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগও নেই। এ ধরনের সুযোগ গ্রহণের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো সুবিধা দরকার, তাও নেই। তা ছাড়া শ্রমিকস্বল্পতা ও দক্ষ জনবলের অভাবকে সামনে টেনে এনে তারা বলছেন, পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চীনে সম্প্রতি শ্রমিকের মজুরি ও কাঁচামালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সস্তায় পণ্য উৎপাদনের জায়গা খুঁজছেন চীনের উদ্যোক্তারা। এ জন্য বিশ্বের যেসব দেশে অবকাঠামো সুবিধা ও সস্তায় শ্রম পাওয়া যাবে, এমন স্থানে নতুন কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি পুরনো কারখানা স্থানান্তর করতে চান তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নি¤œতম মজুরি, কম মূল্যে স্থিতিশীল বিদ্যুৎ, পরিবহন খাতের উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে চীনের বিনিয়োগকারীরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। আফ্রিকার ইথিওপিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশও চীনা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি এই দেশগুলোর রফতানি আয় বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চীনে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল মাত্র ৯৪ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে এক কোটি ৮৯ লাখ ডলারে উন্নীত হয়। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় পরের বছর ২০১০-১১ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ২৮ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭৯ শতাংশ বেশি। এরপর ২০১১-১২ অর্থবছরে রফতানি বেড়ে হয় ১০ কোটি ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এবং গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে ২৪ কোটি ১০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চীনে তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার ছাড়াতে হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোতে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের তুলনায় অতটা ভালো না। বাংলাদেশে উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের ব্যাকওয়ার্ড ফরওয়ার্ড লিংকেজ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে এবং এখানে বায়ারদের যে আগ্রহ আছে, আফ্রিকার দেশগুলো সুযোগ-সুবিধা দিলেও চীনে বিনিয়োগকারীরা সেখানে কারখানা স্থানান্তরের আশঙ্কা নেই। তবে নতুন উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ যেতে পারেন।
পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। তারা কারখানা বড় করছে। বাংলাদেশের যারা পোশাক রফতানিকারক আছেন তারা অনেকেই চান না, ইপিজেডের বাইরে বিদেশি বিনিয়োগ হোক। তবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন নেই এমনটি আমি মনে করি না।’
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে ফ্যাশন ডিজাইন খাতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। ফ্যাশন ডিজাইনে দামও অনেক বেশি, প্রকারও অনেক করা যায়। ওই প্রেক্ষিতে যদি কাজ আনতে হয় তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ মাধ্যমেই আনতে হবে। দেশি উদ্যোক্তারা এখনো সে বাজারে যেতে পারেননি।
বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, ‘চীনে যাদের কারখানা আছে, তাদের অনেকেই পুরো কারখানা বাংলাদেশে রিলোকেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিগত কয়েক বছরে তাদের অনেকেই কথা বলেছে। তাদের স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু যখনই গ্যাস ও বিদ্যুতের বিষয়টা জানতে চেয়েছে, এ ব্যাপারে তাদের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। ফলে তারা আগ্রহ হারিয়েছে।’
তিনি বলেন, চীনের বিনিয়োগকারীরা আফ্রিকার দিকে যেতে চাইছে। কারণ সেখানে গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ে এত সমস্যা নেই। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশসহ এই জোনের শ্রমিকের হাতের কাজের যে দক্ষতা, তা আফ্রিকান শ্রমিকদের মধ্যে পাবে না।
মো. হাতেম বলেন, ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ, ভারতের ১৪ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নেমে আসছে। কারণ চীন সরে যাচ্ছে। বিশ্বের যেসব বাজার বাংলাদেশের দখল করার কথা ছিল সেগুলো দখল করছে ভারত ও ভিয়েতনাম। তারা যেভাবে আগাচ্ছে বিভিন্ন সমস্যার কারণে বাংলাদেশে সেভাবে পারছে না।
বিকেএমইএ সহসভাপতি বলেন, এশিয়ার বাজার কিছুটা দূরে সরে যাবে। কিন্তু আফ্রিকা ওই পরিমাণে ফিডব্যাক দিতে পারবে না। এই জোনের যে অবকাঠামো, পণ্যের মান, বিনিয়োগ এবং সামর্থ্যÑ এই পরিমাণ সামর্থ্য হতে অনেক সময় লাগবে বা হবেও না। ফলে তারা যতই সেখানে যাক না কেন, বৃহৎ আকারে সেখানে তারা সুবিধা করতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার এই জোনে ফিরে আসতে হবে।
বাংলাদেশ এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএ) সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশে এখন যে অবকাঠামোগত অবস্থা তাতে গার্মেন্টস শিল্পে বিনিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। বিদেশি বিনিয়োগ আছে শুধু টেক্সটাইল খাতে। কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে না। যদি এখানে বিনিয়োগ করে তাহলে কাপড় আমদানি করতে হবে না। এ খাতে বিনিয়োগ করতে যে পরিমাণ অর্থ ও দক্ষতা লাগবে সে ধরনের সাহসী দেশি উদ্যোক্তা নেই। চাইলেই ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে কারখানা করার সুযোগ নেই। ব্যাংকও টাকা দিতে পারে না। আর এত সুদ দিয়ে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করা সম্ভবও নয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে ৭৫ শতাংশ ওভেন কাপড় আমদানি করতে হয়। এখানে বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ আছে। চীনের বিনিয়োগকারীরা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে যদি এখানে কারখানা করতে পারে তবে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।
সালাম মুর্শেদী বলেন, গার্মেন্টসশিল্পে দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং চাহিদার তুলনায় ১৫ শতাংশ শ্রমিক কম। যদি বিদেশিরা বিনিয়োগ করে তাহলে দেশের ছোট ও মাঝারি কারখানার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এই মুহূর্তে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন নেই।
বিএইর সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশিরা এসে কারখানা করলে দেশি উদ্যোক্তা কমে যাবেন। মালয়েশিয়ায় প্রচুর গার্মেন্টস আছে কিন্তু সবই চীনের। চীন চলে গেলে সেখানে গার্মেন্টস থাকবে না। এ জন্য দেশি উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী করতে হবে। উদ্যোক্তারা যদি অবকাঠামো সুবিধা পান তবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বা পরবর্তী কয়েক বছরে প্রথম স্থানে চলে আসবে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা ও সরকার একসঙ্গে কাজ করলে এটা সম্ভব।