Published in Banik Barta on Saturday, 21 June 2014.
ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন পাট শিল্পের পথিকৃৎরা
বদরুল আলম
মির্জা আলী বেহরুজ ইস্পাহানী। পাট শিল্পের প্রথম দিককার উদ্যোক্তা। এ শিল্পের পথিকৃৎদেরও একজন। খাতটির সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে জানিয়ে দেন, ‘আমি এখন আর পাট শিল্পের সঙ্গে নেই।’ যদিও চিটাগং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন এ উদ্যোক্তা।
মির্জা আলী বেহরুজ ইস্পাহানীই কেবল নন, পাট শিল্পের পথিকৃত্ উদ্যোক্তাদের অনেকেই এরই মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখনো যারা ব্যবসাটি ধরে রেখেছেন, ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন তারাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়া জুট মিলগুলো পুনরায় ব্যক্তি খাতে ফিরতে শুরু করে ১৯৮২ সালে। ৭৭টির মধ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে আসে একে একে ৩৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ ৩৮টি বেসরকারি জুট মিলের মধ্যে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে ১৯টি।
বেসরকারি জুট মিলগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএর) তথ্য বলছে, পাট শিল্প থেকে এ খাতের পথিকৃৎদের সরে আসার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয় মুন্সীগঞ্জের ব্রড বার্লাপ ইন্ডাস্ট্রিজ। একই বছর বন্ধ হয় খুলনার মহসেন জুট মিলস লিমিটেড। এর পর সর্বশেষ চলতি বছরে বন্ধ হয়েছে নরসিংদীর পূবালী জুট মিলস লিমিটেড। সব কারখানাই বন্ধ হয়েছে মুনাফায় ফিরতে ব্যর্থ হওয়ায়। গত ৩০ বছরে একইভাবে বন্ধ হয়েছে ফরিদপুরের এ.আর হাওলাদার, খুলনার অ্যাজাক্স ও সোনালী, সীতাকুণ্ডুর আনোয়ারা, নারায়ণগঞ্জের অ্যালাইড জুট মিলস লিমিটেড, সাত্তার, তাজ ও নওয়াব আসকারি, চিটাগং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, নরসিংদীর কো-অপারেটিভ, কহিনুর ও ফৌজি চাটকল, কেরানীগঞ্জের দ্য ঢাকা, চট্টগ্রামের মকবুলার রহমান ও সুলতানা, গাজীপুরের ন্যাশনাল ও নিশাত।
বাকি যে ১৯টি মিল সচল আছে, সেগুলোও চলছে ধুঁকে ধুঁকে। লাভজনক হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে কমই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিলগুলো হচ্ছে চট্টগ্রামের এ কে খান, জামালপুরের আলহাজ, নরসিংদীর জনতা ও আলীজান, খুলনার আফিল এবং যশোরের নওয়াপাড়া জুট মিলস।
যোগাযোগ করা হলে জনতা জুট মিলস লিমিটেডের পরিচালক মাহমুদুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, পাট শিল্পে সরকারের দ্বৈত নীতির কারণেই বেসরকারি খাতের মূল উদ্যোক্তারা একে একে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ১৯৮৩-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এ রকমটা হওয়াও অযৌক্তিক কিছু নয়। কারণ মুনাফায় থাকা অবস্থায় মিলগুলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হলেও যখন ফিরিয়ে দেয়া হয়, তখন সেগুলো দেনার দায়ে জর্জরিত।
তার এ বক্তব্যের যৌক্তিকতা পাওয়া যায় মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উদ্যোগে গড়ে ওঠা আনোয়ারা জুট মিলস লিমিটেডের ঘটনায়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ছিল বার্ষিক ৮০ লাখ টাকা। সরকারি সিদ্ধান্তে সে বছরই বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রায়ত্তে নেয়া হয়। বছর দশেক পর ১৯৮৩ সালে আবার ব্যক্তি মালিকানায় ফিরে আসে জুট মিলটি। লোকসানসহ ব্যাংক ঋণের সুদ চক্রাকারে বেড়ে দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ কোটি টাকা।
মাহমুদুল হক বলেন, মূলত দেনার বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়েই পথিকৃত্ উদ্যোক্তারা খাতটি থেকে সরে যাচ্ছেন। তবে সময়মতো যারা পণ্য বহুমুখীকরণে যেতে পেরেছেন তারা এখনো টিকে আছেন। এ ধরনের উদ্যোক্তার সংখ্যা খুবই কম।
জানা যায়, স্বাধীনতার পরপর দেশে জুট মিলের সংখ্যা ছিল ৭৭টি। ১৯৭২ সাল থেকে সবগুলোই বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছিল। এর মধ্যে ৩৮টি প্রতিষ্ঠান পরে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। বেসরকারি খাতে পর্যায়ক্রমে আরো ১০০-এর মতো জুট মিল গড়ে তোলা হয়, যেগুলো বিজেএমএর। এছাড়া বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) আওতায় রয়েছে আরো ৮৬টি প্রতিষ্ঠান।
বিজেএমএ সচিব এ. বারিক খান বলেন, ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেনার ভার বহন করার সামর্থ্য হারিয়েছেন অনেকে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো সমতল ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টাও সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। সরকার বিজেএমসির মিলে ভর্তুকি দিলেও বেসরকারি উদ্যোক্তারা এ ধরনের কিছু পান না। এছাড়া শিল্প সুরক্ষায় আইন করা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এসবই পাটশিল্পের পথিকৃত্ উদ্যোক্তাদের খাতটি থেকে সরে যেতে বাধ্য করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পথিকৃত্ উদ্যোক্তাদের সবাই যে টিকে থাকবেন এমনটা নয়। পাট খাতের মূল পথিকৃৎরা দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিলেও তাদের বেশির ভাগই তা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে শুধু সরকারকে দুষলে হবে না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পাট শিল্পের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সবার সে সুযোগকে কাজে লাগানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাট শিল্পের নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য সরকার ও উদ্যোক্তা উভয়কেই জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন এ-সংশ্লিষ্ট গবেষণা। পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের আকার কী হবে তা এ গবেষণা থেকে নির্ধারণ করতে হবে।