Published in Sangbad on Sunday, 20 July 2014.
বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চ্যালেঞ্জ
মুদ্রানীতি নিয়ে চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক
জাফর আহমদ
মুদ্রানীতি নিয়ে চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক। একদিকে বাজেটে প্রস্তাবিত প্রায়োরিটি বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার মধ্যে দিয়ে পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কৌশল গ্রহণ করা। মাসের শেষার্ধে প্রকাশ হতে যাওয়া মুদ্রানীতিতে এই পরস্পর বিপরীতমুখী দুই ইস্যুকে সমন্বয় করা নিয়ে চাপে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে মতামত নেয়া সম্পন্ন করেছে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতি হবে এ মুদ্রানীতি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর এ মুদ্রানীতিতে সদ্য পাস হওয়া বাজেটে উল্লেখিত প্রধান দুই ‘প্রায়োরিটি’ বেসরকরি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নীচে নামিয়ে রাখার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সুদের হার কমানোর মধ্য দিয়ে টাকার সরবাহ বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারি ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার জন্য মুদ্রানীতি উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য সুদের হার কমাতে হবে। কিন্তু সুদের হার কমানো কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কারণ ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হারে সংগ্রহ করা আমানত সরকারকে দিতে হবে ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ হারে। এ ঘাটতি টাকা তুলে আনতে ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাঝে ঋণ বিতরণ করা সুদের হার বাড়াতে হবে। সরকার এ ধরনের টাকা সংগ্রহ করবে ৩১ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে তুলে আনলে বেসরকারি বিনিয়োগে টান পড়তে পারে। যা পুরো বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকগুলোকে সুদের হার কমানোর পরামর্শ দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা চাপ দিয়ে আসছে সুদ হার কমানোর জন্য। এতে ব্যাংকগুলো উভয় সংকটে পড়তে হবে।
এবারের মুদ্রানীতিতে বড় চাপ থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। যা সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। সরকারের আর্থিক খাতের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারকে এ চাপ সামলাতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকেও বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে সরকারের এ সম্পর্কিত প্রধান সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে হবে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের প্রধান প্রতিশ্রুতি আছে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখা। এটা করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রধান যে কাজ করতে হবে তা ‘মানি সার্কলেশন’ কমাতে হবে। বিদায়ী অর্থবছরে বিনিয়োগে স্থবিরতাজনিত কারণে ব্যাংককে তারল্য বৃদ্ধি পায়। এ জন্য বাংলাদেশ সিএসআর (নগদ জমা সংরক্ষণ) ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করে। এতে অতিরিক্ত আরও ৩২ হাজার কোটি টাকা কোন সুদ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করতে হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাংলাদেশ ব্যাংকে এ ধরনের জমার পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর বাইরে আরও ১৩ শতাংশ আছে সরকারের ঋণ হিসেবে সংগৃহীত। যা এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) হিসেবে বন্ড ও বিল বিক্রয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করে থাকে। সিএলআর-এর পরিমাণও প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা। এ বছরে সরকারকে নিতে হবে ৩১ হাজার কোটি টাকা। সর্বসাকুল্যে সিআরআর ও এসএলআর মিলে মোট জমার পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকা। যার থেকে সরকার সুদ দেয় ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত সুদ হারের চেয়ে কম হারে। এর প্রভাবও পড়বে বিনিয়োগের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাড়ানো হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে রক্ষিত নগদ জমার হার। ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলোকে সুদের হার কমানোর নির্দেশ দিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশ মানা সম্ভব নাও হতে পারে। এতে মুদ্রানীতি দিয়ে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ বাড়ানো ও মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এ জন্য আনুসঙ্গিক বিষয়-অবকাঠামো, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রয়োজন হবে। যা করতে হবে সরকারকে।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট তারল্য আছে। টাকার সমস্যা হবে না। সমস্য হলো অত্যাধিক সুদের হার ও বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ। যা করতে হবে সরকারকে। মূল্যস্ফীতিও এখন ৭ ওপরে থাকলেও মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এখন যেটা করতে হবে বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি, সুদের স্প্রেড কমানো ও ব্যাংকিং খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এটা করা গেলে বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরবে। পাশাপাশি বিনিয়োগের পর উৎপাদিত পণ্য যাতে সহজে বাজারে আসতে পারে- সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুলাই) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা রেখে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। যেখানে ব্যাপক মুদ্রানীতির জোগানও অপরিবর্তিত রাখা হয়। চলতি বছর রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২২ দশমিক ৯০ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (জুলাই-মে) পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময় ছিল ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এ সময় রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। বিদায়ী বছরের অবস্থা বিবেচনায় নিলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য বাজেটে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে তাতে ‘ফিক্সড’ মুদ্রানীতি হলে তা অর্জন করা কঠিন হবে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার যায়’ এমন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সংবাদকে বলেন, সরকারের সব প্রায়োরিটি মুদ্রানীতিতে আওতাভুক্ত না করা গেলেও অসুবিধা নেই। ‘নমনীয় ও ফ্লাক্সিবল’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা গেলে যখন যেমন প্রয়োজন তেমন ব্যবস্থা নেয়া যাবে। গত বছরও এ ধরনের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি মোটামুটি নাগালের মধ্যেই ছিল। রাজনৈতিক সহিংতা না থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগও লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করা সম্ভব ছিল।