Published in Kaler Kantha on Wednesday, 15 May 2014.
কাটছাঁট করেও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা
ফারজানা লাবনী
কাটছাঁট করেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় অঙ্কের ঘাটতিতে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ঘাটতি পূরণে অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে নানা কৌশল ও কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কৌশল বাস্তবায়ন করা গেলে ঘাটতি পূরণ হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থবছরের শেষে এসে এ ঘাটতি আর পূরণ হবে না।
রাজস্ব আদায়ের প্রধান তিনটি খাত আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই নেতিবাচক ধারা রয়েছে রাজস্ব আদায়ের প্রতিটি খাতে। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নতুন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টার নির্দেশও দেওয়া হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম ৯ মাসের চূড়ান্ত হিসাবে ৮৬ হাজার ৭০১ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয় ৭৮ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি দাঁড়ায় সাত হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। ১০ মে পর্যন্ত সাময়িক হিসেবে এ ঘাটতি প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় বড় অঙ্কের এ ঘাটতি পূরণে লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করার জন্য আবেদন জানানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ফলে চলতি অর্থবছরে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে করা হয় ৪৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, মূসক ৫১ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪৬ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা এবং শুল্ক ৩৬ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩২ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে এনবিআরের বৈঠকে বকেয়া আদায়ে কঠোর অবস্থানের সিদ্ধান্ত হয়। বকেয়া আদায় না হলে ব্যবসায় লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ, হিসাব জব্দসহ প্রয়োজনে আদালতের আশ্রয় নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকিবাজ বাড়িওয়ালা, উচ্চ মূল্যের গাড়ির মালিক, বড় বড় শোরুম বা দোকানের মালিকসহ সম্পদশালী ব্যক্তির। এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহপ্রভাবশালী ব্যক্তিও আছেন। এ ক্ষেত্রে বড় মাপের কর ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তিন হাজার ৭১২ জন ব্যক্তির হিসাব জব্দ করতে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ১৫ মে এর মধ্যে এসব ব্যক্তির বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করলে হিসাব জব্দ করা হবে বলেও এনবিআরের নোটিশে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানেও চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বকেয়া পরিশোধ করায় ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করে আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে আদায় হয়েছে প্রায় ৫৩৪ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ হিসেবে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসব কর্মকর্তার নামে করদাতাদের হয়রানি বা অনৈতিক সুযোগ গ্রহণের অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। এনবিআর সদস্যদের আহ্বায়ক করে বিভিন্ন কর অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। জানোনো হয়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, আবুল খায়ের লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানকে এনবিআর চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বকেয়া পরিশোধে নির্দেশ দেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের মূসক বকেয়া ছিল, তা আদায়ে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছেন। অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানি বাড়ায় শুল্ক আদায়ও সম্প্রতি বেড়েছে। এ শাখায় লোকবলের সংকটে আদায় ব্যাহত হয়েছে। সম্প্রতি ৬৮৬ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে।
রাজস্ব ঘাটতি প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর গত তিন মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের অচলাবস্থা দূর হচ্ছে। দোকানপাটে বিক্রিও ভালো। অনেক করদাতা স্বেচ্ছায় বকেয়া এবং চলতি পরিশোধে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে কর ফাঁকিবাজরা অতীতের মতো এখনো রাজস্ব পরিশোধে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে চলেছে। তাই এসব ফাঁকিবাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ে এনবিআর আরো কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
গোলাম হোসেন আরো বলেন, গত পাঁচ অর্থবছরের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অর্থবছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় শেষ দুই মাস মে-জুন রাজস্ব আদায় বেশি হয়। অতীতের এ ধারা চলতিবারেও থাকবে আশা করি। এ ছাড়া ঘাটতি বেশি থাকায় মে-জুন দুই মাসে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআর থেকে চলতিবারে বিশেষ কৌশল নেওয়া হয়েছে।
তবে অর্থবছরের শেষে এসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে ঘাটতি তার সঙ্গে মার্চ-জুন এই চার মাসে রাজস্ব আদায়ে ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হলেই চলতি অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার জের এখনো রয়েছে অর্থনীতিতে। বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়লেও তা আশানুরূপ নয়। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না বলে প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়।