Published in Jaijaidin on Sunday, 26 April 2015.
বাজেটে খড়গ নামছে পরিবার সঞ্চয়পত্রে
আবু সাইম
ব্যাংকের আমানতের সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খড়গ নামছে সবধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর। বর্তমান হারের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমছে এ খাতের সুদ। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা। আর এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীর অধিকাংশই হচ্ছেন নারী।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সুদ হার রয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্রে। এতে শতকরা ১৩.৪৫ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। এ কারণে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রির দৌড়ে প্রায় অর্ধেক দখলে রয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্রের। সরকারকেও সুদ বাবদ বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই এতে কমপক্ষে ২ শতাংশ সুদ কমানো হতে পারে। এ জন্য সুদহার সাড়ে ১১ শতাংশে নামিয়ে আনার কাজ চলছে। পাশাপাশি কমবে অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদও।
বর্তমানে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১২.৫৯ থেকে ১৩.৪৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অপর দিকে ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানতের সুদ ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ১ মার্চ থেকে সরকারি ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে।
অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীরা সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম কেটে গড়ে প্রতি লাখে মাসিক এক হাজার ১০০ টাকা পান। সুদের নতুন হারে তাদের এ আয় এক হাজার টাকায় নেমে আসবে। এতে সুদের হার কমে প্রায় ১১ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এটিসহ অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদ কমাতেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিগগিরই নতুন হার চূড়ান্ত হবে, যা আগামী অর্থবছরের জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখানে দেখা গেছে, বেশি সুদের কারণে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। এতে পুরো বছরের বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা অনেক আগেই পার হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সারাবছরে পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা, সুদ ও মূল পরিশোধ বাদে নিট বিনিয়োগ লক্ষ্য ৭ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। কিন্তু লাভ বেশি পাওয়ায় ইতোমধ্যেই নিট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। সুদ ও আসল পরিশোধ হয়েছে ২ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ সময় মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৮ হাজার ২৮৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই গুণ বেশি। এ বছর নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের ব্যাংক ঋণের আধিক্যের কারণে বাজারে ঋণপ্রবাহ কমে আসছিল। তাই এ ঋণ নির্ভরতা কমাতে বাজেটে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বাড়ানো হয়। কিন্তু এতে সুদের হার বেশি হওয়ায় বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। বছরের মাঝামাঝিতেই পুরো বছরের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। এতে সুদ বাবদ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যা বাজেটব্যয়ে চাপ ফেলছে। ভবিষ্যতে উন্নয়ন ব্যয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া ব্যাংকে সুদ কম থাকায় গ্রহকরা ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়ছেন। যা ব্যাংকের আমানত সংগ্রহে প্রভাব ফেলছে। তাই আগামী অর্থবছর থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমছে।
এ বিষয়ে সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান যায়যায়দিনকে জানান, ব্যাংক ব্যবস্থার চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় এতে বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। এর ফলে সরকারের ঋণ পরিষেবার দায়ভারও বাড়ছে। এখন নতুন করে সুদহার সমন্বয় করা হলে বিক্রিও কমবে সরকারের দায়ও কমবে। তাছাড়া সুদের কম ব্যয় হলে রাজস্বেও চাপ কম পড়বে। এতে রাজস্ব ম্যানেজমেন্ট সুবিধাজনক হবে। বাজেট ব্যয়েও সরকার চাপমুক্ত থাকবে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সৃষ্ট অনিশ্চয়তা, পুঁজিবাজারে অস্থিরতা আর ব্যাংকে নানা জটিলতার কারণে এখন ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রকে বেছে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। কেননা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে মন্দাভাব। অন্যদিকে গ্রাহকদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে জমেছে নগদ টাকা। ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতে সুদ কমিয়ে দিয়েছে, তাই সুদ বেশি হওয়ায় মানুষ বেশি মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র ১৮ বছরের ঊধর্ে্ব যে কোনো মহিলা এবং অবসরপ্রাপ্ত পেনশনারদের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে। শুধু তারা এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার হচ্ছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মহিলাদের জন্য রক্ষিত পরিবার সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। তাই এ দুই শ্রেণির নাগরিক বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুদহার কমানো হলে আমানতকারীদের লাভের অঙ্ক কিছুটা কমে যাবে। এতে হয়তো তাদের একটু সমস্যা হতে পারে, তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা সহনীয় রয়েছে, তাই তাদের প্রকৃত আয় কমবে না। তাছাড়া সুদ বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্ত আমানতকারীদের বাইরেও অনেকে বেশি টাকা পাওয়ার আশায় এতে বিনিয়োগ করেছে। সুদ কমানো হলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরাই সঞ্চয়পত্রে আসবে। এক্ষেত্রে সরকার দুটি বিষয় বিবেচনা করতে পারে। এক, সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা। দুই, বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে আনা। এতে একসঙ্গে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসবে না।
উল্লেখ্য, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াতে ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে সুদের হার বাড়ায় সরকার। এই হার ১ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদ বা মুনাফা হচ্ছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ ও তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। আর তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় ও ব্যাংক মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে।