Published in Jaijaidin on Sunday, 1 March 2015.
রাজনৈতিক অস্থিরতার খড়গ ক্ষুদ্র আমানতকারীদের ঘাড়ে
মার্চে কমছে ব্যাংক আমানতের সুদ জুলাই থেকে কমবে সঞ্চয়পত্রে
আবু সাইম
রাজনৈতিক অস্থিরতার বলি হচ্ছেন ক্ষুদ্র আমানতকারীরা। সুযোগ বুঝে তাদের ঠকাচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদ বুঝে নিলেও যাদের টাকায় এ ঋণ সে আমানতকারীদের আমানতের বিপরীতে সুদের হার কমছে দিন দিন।
রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলো সূত্রে জানা গেছে, মার্চ থেকে সব সরকারি ব্যাংকে মেয়াদি আমানতের সুদ আরো কমিয়ে আনা হচ্ছে। এ হার সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। বর্তমানে মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ হারে রয়েছে ৯ শতাংশ। এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকেও সুদের হার জুলাই থেকে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার।
বিষেজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ এ দুই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আয় কমে গেলে আমানতকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে। এতে করে তারা অতিমুনাফার আশায় বিভিন্ন ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং প্রতারণার শিকার হবে।
তারা মনে করেন, ব্যাংকের আমানতের পর সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি কমানো হলে সাধারণ মানুষ, অবসরভোগী চাকরিজীবী, প্রবাসী ও সমাজের নিম্ন আয়ের বিশেষ কিছু শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যাংকে বিভিন্ন মেয়াদি টাকা জমা রাখেন মূলত মাঝ বয়সী থেকে শুরু করে অবসরে যাওয়া মানুষজন। শেষ জীনবে তাদের পেনশনসহ সারাজীবনের জমানো টাকাই ব্যাংকে রেখে তার ওপর নির্ভর করেই পরিকল্পনা করে থাকনে। এখন এ আয় হঠাৎ করে অনেক কমে গেলে তা এ শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দিতে পারে যা সমাজ ও ব্যক্তি জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, এমনিতেই ব্যাংকে সুদের হার কম হওয়ায় মানুষজন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তার পর আবারো ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমলে আমানতকারীদের ওপর নেতিবাজক প্রভাব পড়বে। যদিও সঞ্চয়পত্রের বর্তমান সুদের হার তুলনামূলক বেশি। এক্ষেত্রে বেশি মুনাফার আশায় কেউ বা ঝুঁকি পূর্ণ বিনিয়োগে জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে অতীতে শেয়ারবাজারের ধস ও বিভিন্ন কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সচেতন কারো সেদিকে যাওয়া উচিত হবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানতকারীদের সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগ বুঝে বেশি সুদ বা লাভের মুখরোচক প্রচারণা নিয়ে অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি মাঠে নামে। অতীতেও দেখা গেছে, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে লাভ না পাওয়ায় আমানতকারীরা যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপে টু ইউ, ইলিংকসহ অসংখ্য কোম্পানির ফাঁদে পদে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এমনকি না বুঝে শেয়ারবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান আগের তুলনায় বেড়েছে। ব্যাংকগুলো অব্যাহতভাবে আমানতের সুদহার কমালেও সে অনুপাতে ঋণে সুদহার কমায়নি। সর্বশেষ হিসাবে ঋণের তুলনায় আমানতে অনেক বেশি সুদহার কমানো হয়েছে। জানুয়ারিতে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ যা এর আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার হয়েছে ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এদিকে অস্থির পরিবেশে ইতিমধ্যেই ব্যাংকের আমানত জমার পরিমাণ কম হচ্ছে। গত ৩ মাস ধরে এর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসেও কমেছে ৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা যা ডিসেম্বরের চেয়ে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম। জানুয়ারি শেষে পুরো ব্যাংক খাতের আমানত স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। আগের মাস ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৭ লাখ ১০ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক মাস ধরেই চলতি আমানত কমার ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে অনেকে ব্যাংকে টাকা জমা করতে পারছেন না। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি থাকায় কেউ কেউ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে হয়তো সেখানে টাকা খাটাচ্ছেন। এতে ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে। অন্যদিকে এখন নতুন ঋণ বিতরণ খুব কম হচ্ছে। অনেক গ্রাহকই অনুমোদন হওয়া ঋণসীমা অনুযায়ী বাড়তি অর্থ নিচ্ছেন না। ব্যাংকে লেনদেন হচ্ছে খুব কম। আবার ঋণ গ্রহণ কম থাকায় ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থ পড়ে রয়েছে। তবে আমানতকারীদের নিয়মিতভাবে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে আমানতে কম মুনাফা দিতে হচ্ছে। এতে আমানতের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়েই খারাপ অবস্থানে চলে যাচ্ছে। এটা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের জন্যই অশনি সঙ্কেত বলে মনে করেন তিনি
অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমানে হয়তো ব্যাংকে অলস টাকা রয়েছে। তবে সুদ কমে যাওয়ায় আমনত জমা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকের আমানতের স্থিতি ফুরিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে সঞ্চয়পত্র, পুঁজিবাজার ও কো-অপারেটিভ সোসাইটির মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। এর বিপরীত ক্রমে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট বাড়বে। তখন স্বাভাবিক পরিবেশে ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো তহবিল থাকবে না। যা সামাল দিতে ব্যাংকগুলোকে আবারো আমানত সংগ্রহে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য করবে।
আবার শেয়ারবাজারের অস্থিরতা, ব্যাংকের সুদ কমে যাওয়ায় এবং তা থেকে প্রায় দ্বিগুণ মুনাফা পাওয়ায় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে মানুষ। সঞ্চয়পত্র বিক্রি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ও উন্নয়ন কর্মকা-ে ধীরগতির ফলে ব্যাংক ঋণ তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। যা পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার দেড় গুণ। এ খাত থেকে সরকারের ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ব্যক্তি বিনিয়োগের পাশাপাশি বড় আকারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে। এতে উচ্চ সুদে সরকারের ঋণ বাড়ছে। আবার রাজস্বে গতি না থাকায় এই ঋণ বাজেটে মারাত্মক চাপ সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থায় আসছে বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করার কথাও ভাবা হচ্ছে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩.৫০ শতাংশ। আর ব্যাংক আমানতের গড় সুদ ৭.২৫ শতাশ। দুয়ের মাঝে সামঞ্জস্য রাখতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই আমানতের সুদের হার কমে গেলে তা আমানতকারী বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে। তাদের মুনাফা কমে যাবে। তবে সরকারের উচ্চ সুদে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার ফলে প্রতি নিয়ত সে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় খাত চাপের মুখে পড়েছে। আবার ব্যাংকের আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় আমানত জমা হচ্ছে না। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাতে হবে। ততে তা অবশ্যই যৌক্তিক হারে হতে হবে।