Published in Daily Janakantha on Wednesday, 11 June 2014.
রাষ্ট্রায়ত্ত ২২ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৩৪ হাজার কোটি টাকা
শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে অনেক লোকসানী প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে
রহিম শেখ ॥ রাষ্ট্রায়ত্ত ২২ প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মোট শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ ১৭২.২৯ কোটি টাকা। যা ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের দশমিক ৫১ শতাংশ। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেক লোকসানী প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে সরকারকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের দক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। এ কারণে প্রতিবছর উৎপাদনের তুলনায় অপচয় হচ্ছে বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানে অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করা গেলে সংস্থাগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৪ প্রতিবেদনে জানা গেছে, সরকারী ২২ প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৩৩ হাজার ৯৯৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে (বিপিসি) ১৪১৮৩.৬৪ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) ৬১৭৫.১৬ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ৪৯৪৪.৬২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ সুগার এ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) ২৭৫৭.০৩ কোটি, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএডিসি) ২২৪৭.৩০ কোটি, বাংলাদেশ অয়েল গ্যাস এ্যান্ড মিনারেল কর্পোরেশন (বিওজিএমসি) ১৩২৭.৯১ কোটি, বাংলাদেশ ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) ৭১৩.৪৬ কোটি, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) ৬৬৪.১৬ কোটি, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২২৯.১৮ কোটি, চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি (সিপিএ) ১৪৯.২৮ কোটি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমসি) ১২৮.৮৫ কোটি ও ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ৭৯.১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ রয়েছে বিসিআইসি ৮৯.৫২ কোটি টাকা, বিটিএমসি ২১.৭৬ কোটি, বিএডিসি ২১.২৭ কোটি, বিএসসি ১৭.৮২ কোটি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) ৯.৬৩ কোটি, বিএসএফআইসি ৫.৯৯ কোটি ও বাংলাদেশ স্মল এ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিএসসিআইসি) ২.৬১ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে না পারলে অপচয় হ্রাস পাবে না। তিনি বলেন, পাশাপাশি সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছেও প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এসব সংস্থার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার দুর্নামের ভাগি হচ্ছে। অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করা গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এ সংস্থাগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানাভাবে লাভজনক করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বেশি দায়ী। তিনি বলেন, অতীতের তুলনায় ঋণ ও ভর্তুকি কিছুটা কমেছে। তবে এটা আরও কমা উচিত।
সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের পেছনে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। এর পরও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান লোকসানের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ১২ সংস্থাকে ভর্তুকি বাবদ ১৪৫৬.৫৯ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে দেয়া হয়েছিল ১৪৫৪.৮৩ কোটি টাকা। যা আগের বছরের চেয়ে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বেশি। সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরও সংস্থাগুলোকে সরকারের ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখতে হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই লোকসানের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
জানা গেছে, সংস্থাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (বিডব্লিউডিবি) সর্বোচ্চ ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। চলতি অর্থবছরে এ সংস্থাকে ৭১০ কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়। যা গত অর্থবছরেও ছিল ৬৭৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে। গতবার যা ছিল ২৯২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে ১৭৮ কোটি ৩৯ লাখ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে ১১৯ কোটি ৭১ লাখ, বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনকে ৯৬ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনকে ৭৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। গতবার এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল যথাক্রমে ১৬১ কোটি ২২ লাখ, ৭৮ কোটি ২৪ লাখ, ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ ও ৬৪ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের নিট লোকসান হয়েছে ৭ হাজার ৯২ কোটি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ২ হাজার ৪৮৯ কোটি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ৩১০ কোটি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের ৪০১ কোটি ৯১ লাখ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের ৩৩০ কোটি, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের ৪৫০ কোটি ৮৪ লাখ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ৪৮ কোটি ৫৩ লাখ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৫ কোটি ৫৭ লাখ, বিটিআরসির ৩৬ কোটি ৭২ লাখ ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের ২৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।