Published in Kaler Kantho on Tuesday, 30 September 2014.
বাণিজ্য সুবিধা বেশি দিন থাকছে না, প্রতিযোগীও বাড়ছে
পোশাকে সক্ষমতা বাড়াতে দরকার অবকাঠামো
রাজীব আহমেদ
চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুরের দূরত্ব এক হাজার ২০০ নটিক্যাল মাইল। বড় জাহাজগুলো বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে পারে না বলে ছোট জাহাজে করে বাংলাদেশি পণ্য পৌঁছে দিতে হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে ‘মাদার ভেসেলে’ করে বাংলাদেশি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয় ইউরোপ-আমেরিকায়। একটি গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের বাড়তি সাত থেকে ১০ দিন সময় লাগে। কোনো কোনো সময় ১৫ দিনও লেগে যায় বলে জানিয়েছে রপ্তানিকারকরা।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) ‘ইনভেস্টমেন্ট রিলেটেড কস্ট ইন অ্যান্ড ওশেনিয়া’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে ৪০ ফুট আকারের একটি কনটেইনার জাপানে পাঠাতে খরচ হয় ৯০০ ডলার। বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারতের মুম্বাই থেকে পাঠাতে খরচ হয় ৫০০ ডলার, আর শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে লাগে ৪২৫ ডলার।
২০২০ সাল নাগাদ পোশাক খাতের রপ্তানি দ্বিগুণ করার সুযোগ আছে বাংলাদেশের সামনে। তবে তা অর্জনের জন্য অবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নতি করতে হবে বলে মনে করছে বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা। একই ধরনের মত দেশীয় ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের। তারা বলছে, মধ্য আয়ের দেশ হলে আগামীতে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগী দেশ ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে। এতে বাণিজ্য সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে পোশাকসহ রপ্তানি খাতে টিকে থাকতে দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই।
এ জন্য সময়ও খুব বেশি নেই। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চায়। এরপর আরো ছয় বছর পর্যবেক্ষণে থাকবে বাংলাদেশ। এরপর বাতিল হবে শুল্কমুক্ত সুবিধা। বাংলাদেশের সামনে বিপদ বেশি দূরে নয়। ভারতের সঙ্গে ইউরোপের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে। অফুরন্ত গ্যাস-বিদ্যুতের দেশ মিয়ানমারও পেয়ে গেছে ইউরোপে শুল্কমুক্ত সুবিধা। যেখানে শ্রমের ব্যয় বাংলাদেশের চেয়েও সস্তা। যুক্তরাষ্ট্র ১১টি দেশের সঙ্গে ‘ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ নামের একটি চুক্তি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই চুক্তি হলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) পরিচালক মোস্তফা আবিদ খান ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন জিএসপি স্কিম; বাংলাদেশের এর প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, জিএসপি সুবিধা পাওয়ায় পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ টি-শার্ট, জার্সি, পুলওভার, কার্ডিগান, ওয়েস্টকোট ও কিছু টেক্সটাইল পণ্যের বাজার হারাতে পারে।
শ্রমের মূল্যের দিক দিয়েও বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। বাংলাদেশের মজুরি কাঠামো এখন প্রতিযোগী অনেক দেশের মজুরি কাঠামোর কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গত ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক খাতে ভারত মজুরি দেয় ৭১ ডলার, শ্রীলঙ্কা ৭৩ ডলার, ভিয়েতনাম ৭৮ ডলার, পাকিস্তান ৭৯ ডলার ও কম্বোডিয়া ৮০ ডলার। বাংলাদেশ গত ডিসেম্বর থেকে নিম্নতম মজুরি ৬৯ ডলার দিচ্ছে। ফলে মজুরির দিক দিয়ে আগের মতো অনেক বেশি এগিয়ে থাকা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষক ও পোশাক কারখানার মালিকরা বলছে, গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা চট্টগ্রাম আট লেন, পোশাকশিল্প এলাকার মতো অবকাঠামো নির্মাণ হলে ও বিদ্যুৎ-গ্যাসের উৎপাদন পর্যাপ্ত হলে শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াই বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে। রপ্তানিকারকরা ব্যাংকের সুদের হার কমানোরও দাবি করে।
২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককেনসি অ্যান্ড কম্পানি জরিপ করে বলেছে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি তিনগুণ বেড়ে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার হবে। তবে এ ক্ষেত্রে তারা পাঁচটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছে। যার মধ্যে প্রথমেই আছে অবকাঠামো। মা্যককেনসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবকাঠামোর অভাব পোশাক রপ্তানির সময় বা লিড টাইম বাড়িয়ে দেয়। আগামীতে অবকাঠামোর অভাব আরো বড় সমস্যা তৈরি করবে। কারণ ভবিষ্যতে ক্রেতারা আরো বেশি ‘ফ্যাশনেবল’ পোশাকের অর্ডার বাংলাদেশে দেবে। যেগুলো তারা দ্রুত পেতে চাইবে। এদিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উন্নয়নে অবকাঠামোর সংকটকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করা হয়।
ওয়েবটেক্স লি. নামের একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নন্দ দুলাল সাহা মনে করেন, বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলে প্রতি ডজন টি-শার্টে ৮০ সেন্ট থেকে এক ডলার পর্যন্ত খরচ কম পড়ত। আবার সময় কম লাগায় বাংলাদেশ অন্য দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে যেত।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেন, বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে যে ট্যারিফ সুবিধা পায় তা মোট খরচের খুব সামান্য অংশ। আগামীতে শুল্ক সুবিধা খুব বেশি কাজে আসবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা রাউন্ড বাস্তবায়ন হলে সব দেশের ক্ষেত্রেই শুল্কহার কমে আসবে। তিনি মনে করেন, সক্ষমতা অর্জনের জন্য অবকাঠামোর দিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন।
গত তিন দশকে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার তেমন নজর দেয়নি। পোশাক পল্লী তৈরির দাবিটি ১৫ বছর পর পূরণ হয়েছে। চার লেনের কাজ ঝুলে আছে কয়েক বছর ধরে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজও গতি পাচ্ছে না। যদিও সেটি এবার প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পে স্থান পেয়েছে। বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দর, আট লেন সড়ক, শিল্প এলাকার মতো অবকাঠামোগুলো হলে আমাদের সময় ও খরচ কমে যাবে। তখন আমরা ১২-১৩ শতাংশ শুল্কছাড়ের আশায় বসে থাকব না। এমনিতেই আমরা অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাব।’
সক্ষমতা বাড়াবে পোশাক পল্লী : মুন্সীগঞ্জে দেশের প্রথম পোশাক পল্লী হচ্ছে, যেখানে কারখানা স্থানান্তর শুরু হবে ২০১৬ সালে। ৫৩১ একর জমির ওই পল্লীতে এক, তিন, পাঁচ ও সাত বিঘা আকারের মোট ৫১৭টি প্লট হবে। মালিকরা মনে করে, এ রকম আরো অন্তত তিনটি পোশাক পল্লী তৈরির কাজ এখনই শুরু করা উচিত। কারণ ঢাকা থেকেই প্রায় এক হাজার ৫০০ কারখানা সরিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৩০০ কারখানা স্থানান্তর করতে হবে।
পোশাক কারখানাগুলো একটি নির্দিষ্ট শিল্প এলাকায় স্থানান্তর করা হলে কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত শর্ত পূরণ হবে। পাশাপাশি তাদের খরচও কমবে। উদাহরণ হিসেবে শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, এখন একটি বায়ো-ইটিপি (বর্জ পরিশোধনাগার) করতে পাঁচ-সাত কোটি টাকা খরচ আছে। একজন মালিকের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। এ কারণে মালিকরা ৪০-৫০ লাখ টাকা খরচ করে কেমিক্যাল ইটিপি করে। যা শুধু জরিমানা এড়ানোর জন্য।
শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, শিল্প এলাকায় কেন্দ্রীয় ইটিপি থাকবে। সেখানে প্রতি মাসে পরিশোধন খরচ দেবে মালিকরা। অনেক বড় পরিসরে সেখানে ইটিপি হবে বলে ইউনিটপ্রতি পরিশোধন খরচও কম হবে।
চার লেন হলে কমবে পরিবহন খরচ : ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হলেও পোশাক কারখানা মালিকদের খরচ কমবে। শহীদুল্লাহ আজিম জানান, বর্তমানে চট্টগ্রামে তাঁদের একটি ট্রাক পাঠাতে ২০ হাজার টাকার বেশি ভাড়া দিতে হয়। কখনো কখনো তা ৪০ হাজার টাকায়ও ওঠে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে যেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়, সেখানে লাগে ১৪ ঘণ্টা। এতে ট্রাক মালিকরা বাড়তি ভাড়া নেয়।