Published in Shokaler Khobor on Tuesday, 24 November 2015.
টিকফায় বাংলাদেশের ওপর যাতে কিছু চাপিয়ে দিতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে: মোস্তাফিজুর রহমান
গতকাল ওয়াশিংটনে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট বা টিকফার দ্বিতীয় বৈঠক। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন। টিকফায় বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে বা কোন কোন বিষয় তুলে ধরা দরকার সে বিষয়ে সকালের খবরের সঙ্গে কথা বলেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, টিকফা চুক্তিতে বাংলাদেশের ওপর যাতে যুক্তরাষ্ট্র জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সফল হওয়া গেলে টিকফা উভয় দেশের জন্য ভালো কিছুও বয়ে আনতে পারে। এ বিষয়ে তিনি অনেক কথা বলেছেন। তার সাক্ষাত্কারের বিশেষ অংশ নিচে দেওয়া হল। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সকালের খবরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসএম আলমগীর।
সকালের খবর : টিকফার দ্বিতীয় বৈঠক শুরু হয়েছে ওয়াশিংটনে। এবারের টিকফা বৈঠককে সার্বিকভাবে আপনি কীভাবে দেখছেন? বৈঠকে বাংলাদেশকে কোন বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া দরকার?
মোস্তাফিজুর রহমান : দীর্ঘ ১৭ মাস পর টিকফার দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে ওয়াশিংটনে। প্রথম বৈঠক ঢাকায় হয়েছিল গত বছরের এপ্রিলে। এই সময়ের মধ্যে আগের এজেন্ডার পাশাপাশি নতুন কিছু বিষয়ের অবতারণা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নতুন কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে চায়, ইতোমধ্যে সে বিষয়ে তারা বলেছে। পাবলিক টেন্ডার, আমদানির ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশে তুলা রফতানির বিষয়, সার্ভিসিং, মেধাস্বত্ব—এসব বিষয় নিয়ে তাদের কিছু দুশ্চিন্তা রয়েছে। এ ছাড়া নতুন আঞ্চলিক ম্যাকানিজম, নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, শ্রমমান উন্নয়নের বিষয়গুলোও তারা জোরের সঙ্গে এ বৈঠকে তুলে ধরতে চায়। অর্থাত্ বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে তাদের যেসব স্বার্থ রয়েছে তারা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশেরও বেশ কিছু নিজস্ব বক্তব্য থাকবে। বাংলাদেশের তরফ থেকে মূলত তিন ধরনের বিষয় তুলে ধরা হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে যেসব বিষয়ে বাংলাদেশকে উন্নতি ঘটানোর কথা বলা হয়েছিল সেগুলোর অগ্রগতি তুলে ধরবে। কতটুকু বাংলাদেশ করতে পেরেছে, কতটা পারেনি তা জানাবে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে। বিশেষত এই প্লাটফর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ যাতে আবার যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি ফিরে পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শূন্য শুল্কে প্রবেশাধিকারের দীর্ঘদিনের দাবি, সে দাবিটি এবার জোরালোভাবে তুলে ধরা দরকার এবং আমি আশা করব বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সেটা করবে। আগামী মাসে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) দশম সভা বসছে কেনিয়াতে। এখানেও শূন্য শুল্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব পাবে। হংকংয়ে ডব্লিউটিও’র যে বৈঠক হয়েছিল সেখানে যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিয়েছিল বাংলাদেশের ৯১ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে। সুতরাং এবারকার টিকফা বৈঠকে শূন্য শুল্কের বিষয়টিই অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হওয়া দরকার। শূন্য শুল্কের বিষয়টি মার্কিন কংগ্রেসে তোলার জন্য অথবা ডব্লিউটিও সম্মেলনে মার্কিন সমর্থন পাওয়া যায় কি না সে বিষয়ে জোর দিয়ে বলা দরকার। সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ১২টি দেশের সঙ্গে যে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তি করেছে তার জন্য বাংলাদেশ ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার দিকটি তুলে ধরা দরকার। শুধু তাই নয়, টিপিপির বিপরীতে বাংলাদেশকে যেন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শূন্য শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয় সেটি বলতে হবে।
একটি কথা বলা হচ্ছিল যে, এবারের বৈঠকে বাংলাদেশ টিপিপিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে কথা বলবে কি না। তবে আমি মনে করি বাংলাদেশ এখনও টিপিপিতে যুক্ত হওয়ার মতো অবস্থায় যায়নি। কারণ টিপিপিতে যেতে হলে শ্রমমান উন্নয়নসহ অনেক বিষয়ে বাংলাদেশকে উন্নতি ঘটাতে হবে। সেগুলো এখনই করতে পারবে না বাংলাদেশ। সুতরাং এই মুহূর্তে মনে হয় টিপিপিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। কেননা টিপিপি নিয়ে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কোনো গবেষণা বা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। সুতরাং আমি মনে করি, এখন টিপিপিতে যুক্ত না হয়ে টিপিপি চুক্তির ফলে প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে যে প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশ তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধাটা আদায় করে নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হল—টিকফার বৈঠকগুলো আরও নিয়মিতভাবে হওয়া দরকার। এভাবে যদি ১৭ মাস পর টিকফার বৈঠক হয় তাহলে চলবে না। নিয়মিত বৈঠক হলে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জোরালোভাবে তুলে ধরা যেত। বাংলাদেশে কিভাবে মার্কিন বিনিয়োগ আরও বেশি আকৃষ্ট করা যায় সেগুলোও ঘন ঘন আলোচনা হতো।
সকালের খবর : টিকফা বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হবে বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : টিকফা হচ্ছে একটি প্লাটফর্ম। যেখানে উভয় দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। এর সুবিধা-অসুবিধা নির্ভর করবে আমরা আমাদের বিষয়গুলো কিভাবে তাদের সামনে তুলে ধরতে পারি তার ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করবে তাদের স্বার্থের বিষয়গুলো কিভাবে আদায় করে নেওয়া যায় সে ব্যাপারে সোচ্চার থাকার। অপরদিকে আমরা আমাদের সমস্যাগুলো এবং দাবি-দাওয়াগুলো কিভাবে আদায় করতে পারি সে ব্যাপারে বেশি করে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ কিন্তু প্রথম দিকে টিকফা চুক্তি করতে চায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চাচ্ছিল। সুতরাং বাস্তবতাটা মেনে নিতে হবে, তবে আমাদের চেষ্টা করা উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব যুক্তি উপস্থাপন করে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সেগুলো খণ্ডন করা বা আমাদের তরফ থেকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা। তবে মনে রাখতে হবে—এ ধরনের প্লাটফর্মে হয়তো কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশের ওপর, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কেননা বৈশ্বিক অনেক বিষয় থাকে যেগুলো হয়তো আইএলও, ডব্লিউটিও বা এ রকম কোনো প্লাটফর্মে আলোচনা হতে পারে, সেসব জায়গায় আলোচনার পথ যেন বন্ধ না হয়ে যায় সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কেননা আইএলও বা ডব্লিউটিওর মতো প্লাটফর্মে বাংলাদেশ অনেক সুবিধা পেয়ে থাকে। সেসব সুবিধা যেন হাতছাড়া হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
সকালের খবর : টিকফা নিয়ে আলোচনা শুরুর দিকে এটি নিয়ে বেশ সামলোচনাও ছিল। তখন অনেকেই বলেছেন, টিকফা চুক্তির বিষয়গুলো সঠিকভাবে জানানো হয়নি। এ অভিযোগ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : যারা টিকফা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন তাদের কাছে অবশ্যই বিষয়গুলো পরিষ্কার ছিল। এটা ঠিক, প্রথম দিকে সবাই বুঝতে পারছিল না টিকফায় কী আলোচনা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কি চাচ্ছে-না চাচ্ছে—সেগুলো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। তবে পরের দিকে এর অনেক বিষয় সরকারের তরফ থেকে পরিষ্কার করা হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল, সেগুলো সমাধানও করা হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি, পরে টিকফার বিষয়বস্তু কিছুটা খোলসা করা হয়েছে এবং এখন আমরা চুক্তির অনেক কিছুই জানি। তবে শুরু থেকেই এ ধরনের বিষয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হলে কোনো সন্দেহ-সংশয় থাকত না। টিকফার আলোচনা যখন টিফাতে ছিল তখন আলাপ-আলোচনা একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে আশার করা হচ্ছে টিকফা নিয়ে এখন আর সে অবস্থা নেই।
সকালের খবর : টিকফার বৈঠকে জিএসপি ফিরে পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে কি না, জিএসপি বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : যদিও আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পায় না। তারপরও আমি মনে করি বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পাওয়া দরকার। কেননা গার্মেন্ট ছাড়া অন্যান্য পণ্য কিন্তু সে দেশে জিএসপি সুবিধা পেত। সেসব পণ্য রফতানিকারকরা তো ক্ষগ্রিস্ত হচ্ছেন। এসব পণ্যেরও রফতানি বৃদ্ধির বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা মার্কিন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এই জিএসপি খুবই দরকার। কেবল মার্কিন বিনিয়োগকারীদের নয়, অন্য দেশের বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করার ব্যাপার রয়েছে। এটা অনেকটা ইমেজের বিষয়। তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি জিএসপি না দেয় তাহলে অন্য দেশ এই সুবিধা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হবে। সুতরাং আমি মনে করি টিকফার বৈঠকে জিএসপি ইস্যুটা বাংলাদেশ খুবই জোরালোভাবে তুলে ধরবে। বিশেষ করে তারা যে ১৬টি শর্ত দিয়েছিল জিএসপি ফিরে পেতে সেসব শর্ত কতটা পূরণ করা হয়েছে সেগুলো সেখানে উপস্থাপন করা দরকার।
সকালের খবর : আপনি জানেন ওষুধ শিল্পের মেধাস্বত্ব সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ শিল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বড় বাজার। টিকফার মাধ্যমে ওষুধ শিল্প কতটা উপকৃত হতে পারে?
মোস্তাফিজুর রহমান : ওষুধ শিল্পের জন্য এ সুবিধা ডব্লিউটিও বাংলাদেশকে দিয়েছে এলডিসির দেশ হিসেবে। ২০২৪ সালের দিকে যদি বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে আমাদের সামনে আর দশ বছর সময় আছে এটাকে ব্যবহার করার। এ বিষয়ে টিকফাতে সরাসরি তেমন কোনো যোগাযোগ আমি দেখি না। কিন্তু যদি আমরা এ শিল্পে মার্কিন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারি, তাহলে লাভবান হবে ওষুধ শিল্প। আর এ ব্যাপারে টিকফার বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ডব্লিউটিও আমাদের যে সুবিধা দিয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি কখনও ব্যত্যয় ঘটে তখন আমরা সে বিষয়গুলো টিকফায় তুলতে পারব। দ্বিতীয়ত, মার্কিনসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ কিভাবে এ খাতে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। আমি মনে করি ওষুধ শিল্পের জন্য মেধাস্বত্বের বিষয়ে ছাড় আমাদের জন্য বিরাট সুযোগ। এ খাতের সব বাধা যদি দূর করা যায়, তাহলে রফতানি প্রচুর বাড়বে। এখন আমরা ১০০টির বেশি দেশে ওষুধ রফতানি করছি, কিন্তু তা খুবই কম। গত বছরে আমাদের ওষুধ রফতানি ছিল মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলারের। অথচ বৈশ্বিক বাজার ছিল ৫২৪ বিলিয়ন ডলারের। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ওষুধের বিশ্ববাজার কত বড়। এই বিশাল বাজার ধরতে এ শিল্পের বাধাগুলো দূর করতে হবে। আর মার্কিন বাজারে ওষুধ রফতানি বাড়াতে যদি কোনো বাধা থাকে সে বিষয়ে টিকফায় আলোচনা করা যেতে পারে।