Published in Vorer Pata and The Daily People’s Times on Tuesday, 24 March 2015.
কর্মসংস্থান বাড়েনি, ৩ বছরে বেকার দ্বিগুণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রতি বৃহস্পতিবার রেলস্টেশন ও বাস টার্মিনালে ভিড় জমান একদল তরুণ। তাঁদের লক্ষ্য- ঢাকা। কারণ এ দেশে ঝাড়–দার থেকে শুরু করে যে কোনো চাকরির নিয়োগ কার্যক্রমই ঢাকায় সম্পাদন হয়। আর এ নিয়োগ সংক্রান্ত সব পরীক্ষা, ভাইভা, যাচাই-বাছাই কারও জীবনে প্রথম, কারও পঞ্চাশতম বা এসব করতে করতে কারও বয়সই শেষে হয়ে যায়। কিন্তু চাকরি নামের সোনার হরিণ থাকে অধরা। মা ফোন করে বলেন, ‘বাবা চাকরিটা কি হয়েছে? পরীক্ষায় পাস করেছিস? দুই বছর হলো। একটা কিছু কর। তোর বাবার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তোর জন্য আশীর্বাদ করছি।’ এদিকে বয়সের ভারে ন্যূব্জ বাবা ফোন দিয়ে বলেন, ‘বাবা আমাদের জন্য নয়; তোর জন্য একটা চাকরি ঠিক কর; বয়স কত হয়েছে খেয়াল আছে তোর!’ হয়তো প্রিয়তমার ফোনও বাজে, ‘তুমি বিসিএস ক্যাডার হও; ব্যাংকার হও- এটা আমি চাই না; একটা ছোটখাট চাকরি জোগাড় করো প্লিজ!’ বড় চাকরি পরে দেখা যাবে। এদিকে একটি চাকরির জন্য ওই যুবকটি অনার্স ফার্স্ট ইয়ার থেকে মুখস্থ করে আসছেন কারেন্ট নিউজ, কারেন্ট ওয়ার্ল্ডের সব সংখ্যা; চাকরি সহায়ক সব গাইড। বিশ্বের ২১৫টি দেশের রাজধানী, মুদ্রা, আয়তন, জনসংখ্যা, রাষ্ট্রনায়কের নাম থেকে সবই তাঁর মুখস্থ! অন্যদিকে চাকরি প্রার্থী ওইসব যুবক একটি সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা পৌঁছান। সকালে পরীক্ষা। রাজধানীর বুকে পা রেখে হাতমুখ ধুয়ে কোনোমতে দুটি পরোটা গিলে পরীক্ষা হলে দৌড় দেন। পরীক্ষা ভালোই হলো। হল থেকে বের হওয়ার পরপরই আসে পর্যায়ক্রমে- মা-বাবা, প্রিয়তমা, বন্ধুদের ফোন। বাসে ওঠে যখন শোনেন, তিনি যে পরীক্ষা দিলেন, তাঁর প্রশ্নপত্র আগেই ফাঁস হয়ে গেছে, তখন মন ভেঙে যায়। বেশিরভাগ যুবকেরাই বারবার ভাইভা দেন; কিন্তু চাকরি মেলে না। কি আর করা। ফিজিক্স থেকে পাস করে চাকরি মেলে হয়তো কৃষি ব্যাংকে; সারাজীবন রসায়ন পড়ে হয়তো ঢুকে পুলিশ বিভাগে; প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা পড়ে তাঁকে ঢুকতে হয় মার্কেটিং জবে। এতে কেউ হন পুরো বেকার। কেউ হন অর্ধেক। কেউ বা কোনোমতে পড়ে থাকেন পেট চালানোর জন্য। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও দেশে যুবকদের জন্য চাকরির নিশ্চয়তা নেই। রাষ্ট্র ডিজিটাল হয়; জিডিপি বাড়ে; বাজেটের আকার বাড়ে; শতশত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি দেশে ঢোকে। কেবল উন্নয়নের চুক্তি হয়। বৈঠক হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয় কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাড়ে না। বাড়ে না কর্মসংস্থান। যে কারণে বাড়তে থাকে বেকারের ভিড়। অন্যদিকে ১টি পদের বিপরীতে উপচে পড়েন হাজার হাজার প্রতিযোগী। দেশের বেকার পরিস্থিতির চিত্রটি আসলে এমনই! কোনো পরিবর্তনই হয়তো হয় না। কেবল নেতাদের আশ্বাস। আর সে আশ্বাসে গুড়ে বালি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ২০১৩ সালের হিসাবে, দেশে বেকার সংখ্যা ২৬ লাখ। ২০১০ সালেও বেকারের সংখ্যা একই ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে প্রতি ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সে হিসাবে, প্রতি বছর কমপক্ষে ১৫ লাখ মানুষের জন্য নতুন কাজ তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ‘পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এ মুহূর্তে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দরকার। এখন বিভিন্নভাবে কাজের মধ্যে রয়েছেন বা কর্মরত আছে ৫ কোটি ৮১ লাখ মানুষ। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪১ লাখ। আর বর্তমানে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৭ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩-এর প্রাথমিক খসড়া প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। শিগগিরই এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। জরিপে দেখা যায়- ২০১১, ১২, ১৩ সাল অর্থাৎ তিন বছরে দেশে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ১৩ লাখের বেশি মানুষ কাজ পেয়েছে। আলোচ্য সময়ে পুরুষ বেকার কমলেও নারী বেকার বেড়েছে। তিন বছরের ব্যবধানে পুরুষ বেকারের সংখ্যা কমেছে ৩ লাখ। এখন ১৩ লাখ পুরুষ বেকার। আবার একইভাবে নারী বেকার বেড়েছে ৩ লাখ। এখন নারী বেকারের সংখ্যা ১৩ লাখ।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের প্রাথমিক এ হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে অর্ধবেকার বেড়েছে এক কোটির বেশি। আর ২০১৪ সালে এসে তা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ। ২০১০ সালের জরিপে দেখা যায়, দেশে অর্ধবেকারের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদ- অনুযায়ী এ হিসাব তৈরি করা হয়েছে। আইএলও মনে করে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হবে। সে হিসাবে বিশাল এ বেকার জনগোষ্ঠী সপ্তাহে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পায় না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে জীবন ধারণ অসম্ভব। এজন্য পরিসংখ্যান ব্যুরো শ্রমশক্তি জরিপে সপ্তাহে ১ থেকে ৩৫ ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পান- এমন ব্যক্তির কাজের হিসাব জরিপে নিয়ে থাকে। তাঁদের অবশ্য অর্ধবেকার বলা হয়। তারা চাকরি করে মাস শেষে বেতন বা মজুরি পান না। টিউশনি, গৃহকর্মের মতো অস্থায়ী কাজ করেন।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলে বর্তমানে যে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে কর্মসংস্থান হবে। এতে প্রতি বছর যত সংখ্যক মানুষ শ্রম বাজারে যুক্ত হয়, তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে।’