Published in Dainik Amader Shomoy on Sunday, 28 September 2014.
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি কমছে
হারুন-অর-রশিদ
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৯ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। একক কোনো দেশ থেকে এটি সর্বোচ্চ আয়। বড় আয়ের এ বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। গত বছর জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে আয় দশমিক ৪৭ শতাংশ কমেছে। এছাড়া বাংলাদেশে শিল্পস্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরিমাণও কমেছে। বর্তমানে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৭০ জন শীর্ষ ব্যবসায়ী আছেন। বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সফরকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিলেন বিশিষ্টজনরা।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে ৩২২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার আয় করে বাংলাদেশ। একই সময়ে ২০১৩ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩২৪ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এই হিসেবে রপ্তানি কমেছে দশমিক ৪৭ শতাংশ। অঙ্কের হিসাবে এটি খুব কম হলেও নিম্নমুখী প্রবণতা উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে আরও দেখা যায় চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের মধ্যে শুধু জানুয়ারি ও জুলাই মাসে ৫০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি হয়েছে। বাকি মাসগুলোয় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫০ কোটি ডলারের নিচে।
বাংলাদেশের জন্য বিশেষ বাজার সুবিধা (জিএসপি) গত বছর ১ জুলাই থেকে স্থগিত ঘোষিত হয় যা গত বছর ১ সেপ্টেস্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। সে হিসেবে এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা না থাকার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এর জের ধরেই এ রপ্তানি কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, সার্বিকভাবে ২০১২ সালে জিএসপিভুক্ত পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। ২০১৩ সালে তা নেমে এসেছে ২ কোটি ১৫ লাখ ডলারে। অর্থাৎ রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। আর চলতি বছর কোনো পণ্যই জিএসপির আওতায় রপ্তানি হয়নি। বাংলাদেশের যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছিল সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্লাস্টিক, সিরামিক, গলফ খেলার উপকরণ, কার্পেট, চশমা, পতাকা, চুরুট ইত্যাদি।
জিএসপি সুবিধা পেয়ে বাজার বাড়াচ্ছিল প্লাস্টিক ও সিরামিক পণ্য। এ সুবিধা স্থগিত হওয়ায় এ খাত দুটি বেকায়দায় পড়ে। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তাদের পণ্য রপ্তানি ব্যয় ২০ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে। এই ব্যয় পুষিয়ে নেওয়াটা সহজসাধ্য নয়। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি কমেছে প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। আবার একই সময়ে সিরামিক রপ্তানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। ২০১৩ সালের প্রথম সাত মাসে ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার ডলারের গলফ সামগ্রী রপ্তানি হলেও চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে তা ৩৪ শতাংশ কমে হয়েছে ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ডলার।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণও কমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপতিরা। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করেন দেশটির ব্যবসায়ীরা। কিন্তু চলতি বছর এই পরিমাণ নেমে আসে ৮১ মিলিয়ন ডলারে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মার্কিন চেম্বার ও ইউএস বিজনেস কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে সভায় প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ হচ্ছে সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম, মাত্র ৩৩১ মিলিয়ন ডলার। তার সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উদার আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। সাতটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করা হয়েছে, যেখানে বিদেশি বেসরকারি কোম্পানিগুলো শিল্পকারখানার জন্য জমি লিজ নিতে পারে।
শেখ হাসিনা আরও জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মতা গ্রহণ করে তখন বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০০১ সালে যখন আমরা মতা ছেড়ে যাই, তখন মার্কিন বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সাত বছর পর ২০০৯ সালে আমার সরকার আবার মতায় ফিরে আসে তখন বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ কোটি ডলারে নেমে আসে। আগামী তিন বছরের মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই বাংলাদেশের মার্কিন বিনিয়োগ এক বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যাক।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদসহ ৭০ শীর্ষ ব্যবসায়ী রয়েছেন। এফবিসিসিআই জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে বাজার বৃদ্ধির জন্য নিজ খরচে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেখানে গেছেন। ইতোমধ্যে আমেরিকান চেম্বার ও আমেরিকান বিজনেস কাউন্সিল এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অ্যান্ড ইউনাইটেড স্টেটস বিজনেস কাউন্সিল ফোরামসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিজনেস মিটিং করেছে এফবিসিসিআই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা প্রদান এবং জিএসপি সুবিধা পুনঃআরোপের বিষয়ে জোরালো দাবি জানানো হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে। এছাড়াও বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও জোরালো করার পাশাপাশি বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হবে বৈদেশিক বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো যায়। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়া শুল্ক প্রবেশাধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। রানা প্লাজাসহ কয়েকটি ঘটনার পর যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল সেটি দূর করে জিএসপি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, মার্কিন আমদানিকারক ও বিনিয়োগকারীরা যেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পায় সে বিষয়ে তৎপর হতে হবে বাংলাদেশকে।
চলমান সফরকে সুযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে এই গবেষক বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘে যোগ দিতে গিয়ে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা পুরোপুরি ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। বিদেশের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের জন্য বেশ কিছু প্রণোদনা রয়েছে। এই সম্পর্কে মার্কিনিদের অবহিত করতে হবে।