Published in Daily Bortoman on Saturday, 31 May 2014.
২২ মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়ন ৩০ শতাংশের নিচে
হাসান মাহামুদ
অর্থবছরের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখন পর্যন্ত ২২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাদের বরাদ্দের এক পয়সাও খরচ করতে পারেনি। ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর ৮টি বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন ৩০ শতাংশের নিচে। এমনকি ১৫৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো অগ্রগতিই নেই। এই অবস্থায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আকারের এডিপি শতভাগ বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সবাই।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৫৫ শতাংশ। বিভাগটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাকি সময়ে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে শেষ দুই মাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে আরও ২৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। তবে উন্নয়ন খাতে অল্প সময়ে এত বেশি অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, তাড়াহুড়ো করে অর্থ ব্যয় করলে উন্নয়ন কাজের গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেবলমাত্র ঠিকাদারের বিল ও অর্থব্যয় প্রকল্পের অগ্রগতি নয়। এতে সরকারি তহবিলের বিপুল অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, অর্থবছরের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাদের বরাদ্দের এক পয়সাও খরচ করতে পারেনি। সংশোধিত এডিপিতে এই বিভাগের জন্য এক কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বিভাগের অগ্রগতি শূন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১০ মাসে তাদের বরাদ্দের মাত্র ৫ শতাংশ অর্থ খরচ করতে সক্ষম হয়েছে। এ বছর মন্ত্রণালয়টির জন্য বরাদ্দ রাখা আছে তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ খরচ করেছে মাত্র ১২ শতাংশ। মন্ত্রণালয়টির জন্য বরাদ্দ ৭৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৯ কোটি ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১৮ শতাংশ। মন্ত্রণালয়টির জন্য বরাদ্দ রাখা আছে ৬৭ কোটি ৩ লাখ টাকা, খরচ হয়েছে মাত্র ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৬১ হাজার টাকা। পদ্মা সেতুর কারণে গত সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে আলোচিত সেতু বিভাগ এ পর্যন্ত এডিপির মাত্র ২৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে। এ বছর বিভাগটির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই হাজার ৯০ কোটি টাকা। কিন্তু এ পর্যন্ত বিভাগটি খরচ করতে পেরেছে মাত্র ৫১৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। নির্বাচন কমিশন ২৭ শতাংশ এবং পরিকল্পনা বিভাগ ২৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। এছাড়া ৫০ শতাংশের নিচে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে এ ধরনের ২২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে পরিসংখ্যান বিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগ, এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য, সমাজকল্যাণ, পাট ও বস্ত্র, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা, পানিসম্পদ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ছয় বছরের কোনো বছরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপি বাস্তবায়ন কারতে পারেনি সরকার। অধিকাংশ সময় দুই দফা সংশোধন করতে হয়েছে। অর্থবছরের শেষ দিকে এক দফা এবং পূর্ববর্তী অর্থবছরের হিসাব চূড়ান্ত করার সময় আরও এক দফা সংশোধন করতে হয়। নির্বাচনী বছর আসলেই কেবল এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়ে। এতে কাজের মান ভালো হয় না। বরং দুর্নীতি বাড়ে। আর বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পে সারা বছরই জটিলতা লেগে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে এডিপিতে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা বাড়েনি (শতাংশ হিসেবে)। কয়েক বছর আগে সেন্টার পলিসি ফর ডায়ালগ (সিপিডি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের আয় করা সহজ, কিন্তু ব্যয় করা কঠিন। তাদের ভাষায় সরকার ১ টাকা আয় করতে পারলেও, ১ টাকা খরচ করতে পারে না, কাজের মানের অবস্থাও সঙ্গীন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, সারা বছর ধরে উন্নয়ন বরাদ্দের ব্যয়ে গতি থাকে না। এ জন্য বছর শেষে অর্থ ব্যয়ের হিড়িক পড়ে যায়। এ জন্য উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। মানহীন ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদন প্রক্রিয়া, অর্থ ছাড় ও প্রক্রিয়াগত ত্রুটি দূর করা জরুরি। নইলে গুণগত মানসম্পন্ন ও দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
এদিকে শতাধিক প্রকল্পের কোনো অগ্রগতিই নেই বলে জানা গেছে। জাতীয় উন্নয়নে গৃহীত ১৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাবে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ব্যয় ও সময়। এসব প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ ১৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবায়ন ১ শতাংশও নয়, এমনকি অনেক প্রকল্পে ব্যয় হয়নি এক টাকাও। জানা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিবছর প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও আর্থিক সামর্থ্য ও দক্ষতার সমন্বয় করা হয় না। এর ফলে অনেক প্রকল্পে শুধু অর্থের অপচয় হয়। আইএমইডি’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের এডিপি’র আওতায় ৭৫টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দের এক পয়সাও ব্যয় হয়নি। এ প্রকল্পগুলোর অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৮৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। একই সময়ে ৭৯টি প্রকল্পের অধীনে কিছু টাকা ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এ ধরনের প্রকল্পের অনুকূলে ৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এছাড়া ২০১২-১৩ অর্থবছরে এডিপির আওতায় মোট ১ হাজার ৩২৮টি প্রকল্প ছিল। এর মধ্যে অগ্রগতি শূন্য এমন তালিকায় রয়েছে ১৫৪টি প্রকল্প। একেবারেই অর্থ ব্যয় হয়নি এমন ৭৫ প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দের মধ্যে বৈদেশিক সহায়তার আকার ধরা হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা। আর ৭৯টি প্রকল্পে অনুকূলে ৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে সরকারের নিজস্ব বরাদ্দ ছিল ৪২ কোটি। বাকি টাকা বৈদেশিক অংশ। কিন্তু অর্থছাড়ের অভাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন গতি পায়নি।