Published in The Daily Janakantha on Sunday, 7 September 2014.
উন্নয়নে নয়াদিগন্ত বিসিআইএম করিডর
মো. মেফতাউল ইসলাম
বর্তমানে পৃথিবীতে রাষ্ট্রগুলো একাকী এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। এ কারণে আমরা এখন বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর সংগঠিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করি। আবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রেও এখন রাষ্ট্রগুলোর মাঝে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। তবে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি উপেক্ষিত হলেও এখানে বিভিন্ন সময় পারস্পরিক সংযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে। আর এরকম একটি উদ্যোগ হলো বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর (বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার-ইকোনমিক করিডর) স্থাপনের প্রচেষ্টা।
সম্প্রতি চীনের কুনমিং-এ চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যমেলায় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের বিষয়টি আবার সামনে আসে। উল্লেখ্য যে, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণের বিষয়টি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন চীন, ভারত ও বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ। ১৯৯৯ সালে কুনমিং-এর একটি মিটিংয়ে বাংলাদেশ হতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), ইন্ডিয়া হতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ, চীন হতে ইউনান একাডেমি অব সোস্যাল সাইন্স সর্বপ্রথম এ ধরনের একটি করিডর নির্মাণের ধারণা দেয়। এরপর প্রতিবছর বেসরকারী পর্যায়ে বিসিআইএম ফোরাম নামে একটি সম্মেলন হতে থাকে। ধীরে ধীরে বিষয়টি ওইসব দেশের সরকারী প্রতিনিধিদের নজরে এলে তারাও এ নিয়ে নড়েচড়ে বসে। অবশেষে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কুনমিং সম্মেলনে বিসিআইএম করিডর নির্মাণের চূড়ান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।
ইন্ডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া ও মায়ানমারের মধ্যে বিসিআইএম করিডর স্থাপনে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করতে সম্মত হয়, যা এই এলাকার অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করে। যদি এটাকে বাস্তবে রূপান্তর করা যায় তাহলে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিত্রকে পালটে দেয়া সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এই করিডর স্থাপিত হলে দেশগুলোর মাঝে জ্বালানির অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত হবে। তাছাড়া এটি এশিয়ার অর্থনৈতিক সংহতি এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বিসিআইএম এলাকায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যায় দুই-পঞ্চমাংশ লোক বাস করে এবং এখানকার মোট জিডিপি বৈশ্বিক জিডিপির এক-দশমাংশ। এই এলাকায় রয়েছে বিশ্বের দুই উদীয়মান পরাশক্তি ভারত ও চীন। অন্যদিকে রয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। দেশগুলোর মাঝে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, দ্রব্য, সেবা, জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধি, অশুল্ক বাধা দূরীকরণ, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের সম্মিলিত উত্তোলন প্রভৃতি বিষয়কে মাথায় রেখে এই করিডরটি নির্মাণের চিন্তা করা হয়। তাছাড়া ইতিহাস বিখ্যাত প্রাচীন সিল্ক রুটটি এই দেশগুলোকে বিসিআইএম করিডর নির্মাণে অনেকটা উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা জানি, প্রাচীন সিল্ক রোড ইউরোপ হতে প্রসারিত হয়ে ইজিপ্ট, সোমালিয়া, আরব উপদ্বীপ, ইরান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, মিয়ানমান, জাভা-ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনামের মাঝ দিয়ে চীন পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে এই সিল্ক রুট একসময় প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ এটি ছিল এশিয়ার সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্পর্কের একমাত্র সেতুবন্ধন। একসময় এই রুট দিয়ে অসংখ্য ব্যবসায়ী, বণিক, তীর্থযাত্রী, সৈনিক এবং নগরবাসী দেশ হতে দেশান্তরে যেত।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরীয় এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। এছাড়া শি জিনপিং বাংলাদেশ-চীন-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর দ্রুত সম্পাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ এই করিডর স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এই করিডর নির্মাণে অত্যন্ত আগ্রহী। বাংলাদেশ তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর (বিশেষত চীনের) সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান চিত্র বিশ্লেষণে বলা যায়, বাংলাদেশ বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। প্রতিবেশি ভারত, মিয়ানমার, চীন যেভাবে তাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পেরেছে বাংলাদেশ তেমনটি পারেনি। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন ওই দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই কম। তাই বাংলাদেশ এ ধরনের একটি লিঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে ওই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হবে এটাই স্বাভাবিক।
চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু। চীন বাংলাদেশের উন্নয়নে সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনছে। আমি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাই এ কারণে যে তিনি অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। তাঁর এই সফরের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের নবায়ন হয়েছে এবং নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এটি আমাদের অর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র ইউরোপ ও আমেরিকা হতে এশিয়ামুখী হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। তাই বাংলাদেশের উচিত এ থেকে যতটা সম্ভব সুবিধা আদায় করে নেয়া। আর বাংলাদেশকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে বিসিআইএম করিডর বাস্তবায়নে আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের সাথে ইতিবাচক সম্পর্কের পুর্ণজাগরণ ঘটাতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বর্ডার, নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে যেসব দ্বিপাক্ষিক সমস্যা রয়েছে সেগুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে। কেননা এই করিডরটি বাংলাদেশ হয়ে ইন্ডিয়া দিয়ে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনে প্রবেশ করবে। এ ক্ষেত্রে আমরা চীনের সহযোগিতার মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারি এবং আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি তৈরি করে এ অঞ্চলের শান্তি ও সংহতি রক্ষা করতে পারি।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ২০০ কিলোমিটার ভূ-সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার পূর্বে দু’দেশের মাঝে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। ইন্ডিয়া ছাড়া মিয়ানমারই একমাত্র দেশ যার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত সংযোগ রয়েছে এবং দুদেশের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণের বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। মিয়ানমার তার হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট হতে তাদের উদ্বৃত্ত জ্বালানি আমাদের সরবরাহ করতে পারে এবং এছাড়াও দুদেশের মাঝে অন্যান্য উন্নয়নমূলক বাণিজ্য হতে পারে। তাই দুদেশের জনগণের সুবিধার জন্য ট্রান্সপোর্ট লিঙ্ক ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রজেক্ট গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে সম্মত হয়েছিল। এখানে তাংব্রো থেকে বাউলিবাজার পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার পথ নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বার্মিজ কর্তৃপক্ষের নিকট আরেকটি প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটি হলো বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর টেকনাফ-মংডু-সির্ত্যে লিঙ্করোড প্রতিষ্ঠা করা যেটি বিকল্প যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কক্সবাজার থেকে বাউলিবাজার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের ত্রি-দেশীয় হাইওয়ে প্রতিষ্ঠা করা গেলে সেটি এই দেশগুলোর মাঝে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুবিধা বয়ে আনবে।
ইন্ডিয়া ও মিয়ানমারের মাঝে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক অনেকটাই ভাল। বিশেষত সীমান্ত নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তারা অভাবনীয় সম্পর্ক তৈরি করেছে। ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সীমান্ত রয়েছে। ইন্ডিয়া ও মিয়ানমারের মাঝে সীমান্ত সহযোগিতা স্থাপিত হওয়ায় অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্য, মাদক পাচার এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর অনুপ্রবেশ অনেকটা কমে গেছে।
ইন্ডিয়া, মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে আমাদের সমুদ্র ও বিমান যোগাযোগ রয়েছে। এখন সড়ক যোগাযোগ বা স্থল যোগাযোগ সরাসরি না থাকায় এটার উপযোগিতা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। কেননা যোগাযোগের ক্ষেত্রে সড়ক যোগাযোগ সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল। তাছাড়া এটি যোগাযোগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যমও বটে। যদি বিসিআইএম করিডর স্থাপন করা যায় এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ অনেকটাই সুবিধা পাবে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ কারণে ধন্যবাদ জানাই যে, তিনি ধীরে ধীরে পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করতে সচেষ্ট হচ্ছেন। এছাড়া তিনি বিসিআইএম করিডর স্থাপনে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেবেন বলেও চীন সফরে ঘোষণা দিয়েছেন। এটি অবশ্যই ভাল একটি দিক। এই লিঙ্ক রোডটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক করিডরের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল করবে। এই করিডর শুধু দেশগুলোর মাঝে বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই গতিশীল করবে না বরং দেশগুলোর জনগণের মাঝে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদান বাড়িয়ে দেবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের দেশের দায়িত্ব হলো মিয়ানমারের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং উভয় দেশের সীমান্ত সমস্যা মোকাবেলায় সীমান্ত ব্যবস্থাপনা চুক্তি স্বাক্ষর করা। আমাদের এই দরিদ্র ও অনুন্নত এলাকায় বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য এই করিডরই একমাত্র আশার আলো হিসেবে দেখা দিতে পারে। এছাড়া এর মাধ্যমে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলো প্রশমিত হবে।