Published in Amader Shomoy on Wednesday, 7 January 2015.
সামষ্টিক অর্থনীতি ইতিবাচক স্থবির বিনিয়োগ
আবু আলী
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের প্রথম বছরে অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরেনি। তবে ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা ছিল। গত এক বছরে মহাজোট সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতি সূচকগুলো ভালোই ছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। নতুন মাত্রায় উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কৃষি খাতের উৎপাদনও ব্যাপক ছিল। তবে ন্যায্যমূল্য পাননি প্রান্তিক কৃষক।
এদিকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ছিল একেবারে স্থবির। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এডিপি বাস্তবায়নের অবস্থাও খুবই খারাপ। রাজস্ব আদায়েও রয়েছে ধীরগতি। এতে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ চাপের মুখে পড়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক খাতেও আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। বাস্তবে দুর্বল অবকাঠামো ও অপর্যাপ্ততার মধ্য দিয়েই কেটেছে বছরটি।
বছরজুড়েই পুঁজিবাজারে ছিল নেতিবাচক প্রবণতা। জনশক্তি রপ্তানিতে এক বছরে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। আর ব্যাংকিং খাতে চলছে চরম অস্থিরতা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ। ব্যাংকে যে ধারা চলছে, এটি গোটা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত বহন করছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, উৎপাদনমুখী শিল্প সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এখন অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
অর্থনীতির সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমান বৈদেশিক রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছর এই দিনে ছিল এক হাজার ৮০৪ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে নভেম্বরÑ এই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৬২০ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স আসে ৫৫৬ কোটি ডলার। এ সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানি ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে শূন্য শুল্কে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে কয়েক হাজার শতাংশ পর্যন্ত। যদিও গত ৫ মাসে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল খুবই কম। ফলে আমদানির নামে ব্যবসায়ীরা বিদেশে অর্থ পাচার করছেন কি না, সে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত এক বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছে, গত এক বছরে বিনিয়োগ তো হয়ইনি, উল্টো বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে দেশ থেকে। টাকার অঙ্কে যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। পাচারের অর্থই আবার দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে ফিরে আসছে বলে আশঙ্কা সিপিডির।
অন্যদিকে, এডিপির আকার ক্রমান্বয়ে বড় হলে প্রকল্পের গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যয়ের প্রবণতার ফলে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত এডিপির মাত্র ২১ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা ১৫ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে।
বছরজুড়েই সংস্কার করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ ধারা এখনো অব্যাহত রেখেছে। তবে সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি সংস্থাটি। বিশেষ করে প্রাথমিক শেয়ার অনুমোদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে। ফলে সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের আরেকটি বছর পার হলেও বিনিয়োগকারীদের হতাশা বা হাহাকার পুরোপুরি কাটেনি। পুঁজিবাজারে আসা নতুন কোম্পানির অনেকগুলোই নিম্নমান, দুর্বল মৌলভিত্তি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিয়ে বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার-সংশ্লিষ্ট সবার মনেই ছিল নানা প্রশ্ন ও সংশয়।
অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, গত ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হারও সন্তোষজনক নয়। চলতি অর্থবছরে দেড় লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার গত ৫ মাসে মাত্র ২১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। বছর শেষে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। ফলে রাজস্ব ঘাটতি উন্নয়নকে বড় ধরনের সংকটের মুখে রেখেছে। এ ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের প্রকল্পগুলো খুবই ধীরগতিতে এগিয়েছে। ফলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তিনি বলেন, গত এক বছরে আর্থিক কর্মকা- ছিল মিশ্র। ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এখনো চলছে। ঋণপরিস্থিতির ক্রমাবনতি হয়েছে। খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতিও ভালো নয়। মূলধন ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক হয়নি। এমনকি যে গতিবিধি দেখা যাচ্ছে, সেটিও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ব্যাংকিং খাতে চলছে চরম অস্থিরতা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ। ব্যাংকে যে ধারা চলছে, এটি গোটা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত বহন করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্ত হতে হবে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না। আর যখন কোনো অনিয়ম ধরা পড়বে তখনই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশে আটকে আছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিনিয়োগে সমস্যার জন্য প্রচলিত প্রতিবন্ধকতা, সংস্কারের অভাব ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। এ জন্য আর্থিক খাতে একটি কমিশন গঠনের পরামশ দেন তিনি।